কুষ্টিয়ায় ক্যাপসিকাম চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন বুনেছেন কৃষকেরা
মিরপুর ও ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি: কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে উচ্চফলনশীল সবজি ক্যাপসিকাম চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চাঁদপুর ইউনিয়নের নানা বয়সি অন্তত ৩০ জন কৃষক। এক সপ্তাহে প্রায় ৩ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করেছেন তারা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে খরচ বাদে ১৪ লক্ষাধিক টাকা মুনাফা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী কৃষকরা।১৮ জানুয়ারি শনিবার দুপুরের ১২টার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাকা সড়ক ঘেঁষে নিয়ামতবাড়িয়া মাঠপাড়া এলাকা। সেখানে চারদিকে জাল দিয়ে ঘিরে মালচিং পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করা হয়েছে। সবুজ গাছে ঝুলছে ফল। ৪-৫ জন করে কৃষকরা দল বেঁধে কেউ গাছ থেকে ফল তুলছেন, কেউ পরিষ্কার করছেন। কেউবা আবার আধুনিক যন্ত্রে পরিমাপ করে প্যাকেট করছেন বাজারে নেওয়ার জন্য। চলতি মৌসুমে চাঁদপুর ইউনিয়নের নিয়ামতবাড়িয়া গ্রামের মাঠপাড়া এলাকায় প্রায় ১০ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম উভয় চাষ করেছেন ওই ৩০ কৃষক। ভালো ফল ধরায় এবং লাভজনক চাষ হওয়ায় ক্যাপসিকাম চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন আশপাশে এলাকার কৃষকেরা । স্বপ্ন বুনছেন ভাগ্য পরিবর্তনে।কৃষক লিখন আলী বলেন, জমির ইজারা, চারা, সার, পরিচর্যাসহ ১০ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। গত সাত দিনে প্রায় ২ হাজার কেজি ক্যাপসিকাম তুলেছেন। প্রতি কেজি ক্যাপসিকাম পাইকারি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে ৩ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। জমিতে যে পরিমাণ ক্যাপসিকাম হচ্ছে, তাতে উৎপাদন আগামী দুই মাসে আরও প্রায় ১৪ হাজার কেজির প্রত্যাশা করছেন। এতে অনায়াসেই আরও ২১ থেকে ২২ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি সম্ভব হবে।তিনি আরও বলেন, জমির ইজারা, চারা, সার, পরিচর্চাসহ দশ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় দশ লাখ টাকা। গত সাতদিনে প্রায় দুই হাজার কেজি ক্যাপসিকাম তুলেছেন। প্রতি কেজি ক্যাপসিকাম পাইকারি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে তিন লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। জমিতে যে পরিমাণ ক্যাপসিকাম হচ্ছে তাতে উৎপাদন আগামী দুই মাসে আরও প্রায় ১৪ হাজার কেজির প্রত্যাশা করছেন। এতে অনায়াসেই ২১ থেকে ২২ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী।জানা গেছে, চাঁদপুর ইউনিয়নে জঙ্গলি আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতি নামে কৃষকদের একটি সংগঠন রয়েছে। সমিতির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন খসরু ২০২৪ সালে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে দুই বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করেন। সে বছর এ চাষে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি প্রায় ৪ লাখ টাকা মুনাফা পান। এতে ক্যাপসিকাম চাষে আগ্রহ বাড়ায় সমিতির অন্য সদস্যদেরও। তাদের মধ্যে ৩০ জন নানা বয়সি শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত কৃষক যশোর অঞ্চলের টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ামতবাড়িয়া মাঠপাড়া এলাকায় ১০ বিঘা জমিতে নিরাপদ উচ্চফলনশীল সবজি ‘ইন্দ্রা গোল্ড’ জাতের ক্যাপসিকাম চাষ করেন। ১২০ দিন জীবনকালের এ সবজির চারা রোপণের ৬০ দিনের মাথায় ফল দেওয়া শুরু হয়েছে।এ দিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ক্যাপসিকাম চাষ করে চমক দেখিয়েছিলেন সবুজ আলী (৩৫) নামে একজন কৃষক। ইউটিউব দেখে উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামে ৬০ শতাংশ জমিতে ( ১ এক বিঘা ১৬ কাটার একটু বেশি) জমিতে প্রথমবার চাষ করেছেন উচ্চফলনশীল এই সবজি। প্রথমবারই সফলতা পেয়েছিলেন তিনি। ২০২৪ সালে ১ জানুয়ারি থেকে তিনি এই সবজিটি বিক্রি করতে থাকেন। সে বছরে তিনি প্রায় ৬ লক্ষ টাকা মত লাভ করেন।তিনিও যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে নিরাপদ উপায়ে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণে কীটনাশক ছাড়া আবাদ ও ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি।খাবারে বাড়তি স্বাদ যোগ করতে ক্যাপসিকাম ব্যবহার হয়। বাজারে সবুজ, লাল ও হলুদ; তিন রঙের ক্যাপসিকাম পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ক্যাপসিকামে ৮৬০ মিলিগ্রাম প্রোটিন থাকে। সেইসঙ্গে থাকে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, ই, কে, থিয়ামিন, ফলিক অ্যাসিড, রাইবোফ্লাভিন ইত্যাদি। এর মধ্যে সবুজ ক্যাপসিকাম অল্প বয়সীদের জন্য উপকারী। এতে ক্যাপসাইসিন নামক এক ধরনের উপাদান থাকে, যা ডিএনএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানের সংযুক্ত হওয়াতে বাধা দেয়। এটি ক্যানসার প্রতিরোধেও কাজ করে। এ ছাড়া মাইগ্রেন, সাইনাস, সংক্রমণ ও দাঁতের ব্যথা দূর করে।চাষ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে কৃষক মুন্সী মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, "প্রথমবারের মতো ক্যাপসিকাম চাষ করা হয়েছে। ক্যাপসিকাম চাষ খুবই সহজ। যেভাবে মরিচ চাষ করা হয়, একইভাবে এটিও করা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছে পোকামাকড় যাতে আক্রমণ না করে এবং রোগবালাই ছড়িয়ে না পড়ে। তাহলে কিন্তু ফলন আসার আগেই গাছ মরে যাবে। এটি সালাদ ও কাঁচা খাওয়া যায় বিধায় কীটনাশকমুক্ত চাষ করতে হবে। কোনও ধরনের ওষুধ কিংবা কেমিক্যাল ব্যবহার করা যাবে না।"তিনি আরোও বলেন, গাছে প্রচুর ফল দেখে খুব ভালো লাগছে। বাজারে ভালো দাম থাকায় ব্যাপক লাভের আশা করছি। ধান, পাট, পিয়াজসহ অন্যান্য চাষাবাদের পাশাপাশি এ বছর ৩০ জন মিলে ক্যাপসিকাম চাষ করেছি। গেল সাত দিন ধরে ফল তুলে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা ও ঢাকাতে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান কৃষক গোলাম মোস্তফা। তার ভাষ্য, ভালো ফলন হওয়ায় প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে কৃষকরা দেখতে আসেন। তাদের পরামর্শও দিচ্ছেন তারা।বিদেশি সবজি চাষের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন কুষ্টিয়া মিরপুর থানার চিথলিয়া এলাকাল কৃষক রাশেদুজ্জামান । তিনি বলেন, গাছে রোগবালাই নেই, মালচিং পদ্ধতিতে বিষমুক্ত চাষাবাদ হয়েছে। দেখে শুনে খুব ভালো লাগছে। আগামীতে ভাবছি কয়েক বিঘা জমিতে এ চাষ করব।জঙ্গলি আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন খসরু বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে গত বছর দুই বিঘা জমিতে প্রথম ক্যাপসিকাম চাষ করেছিলাম। এতে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচে প্রায় চার লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় আমার দেখাদেখি সমিতির অন্যান্য সদস্যদের আগ্রহ বাড়ে এ চাষে। সেজন্য এ বছর ৩০ জন মিলে ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। আগামী বছর ২৫ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষের পরিকল্পকনা রয়েছে।উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের ফসল। একদল কৃষক ক্যাপসিকাম চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। কৃষি অফিসের পরামর্শ, উপকরণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকরা প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা খরচ করে ২৪ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রির করতে পারবেন এমন স্বপ্ন বুনছেন।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, উচ্চমূল্যের সবজি ও ফসল চাষাবাদে যশোর টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের পরামর্শ, উপকরণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এ সবজি চাষ করে কৃষকেরা প্রচুর লাভবান হবেন। ক্যাপসিকামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, প্রোটিন, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি রয়েছে। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধও কাজ করে।