পদ্মায় অবৈধ ড্রেজারে বালু উত্তোলনের হিড়িক
শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি: প্রমত্তা পদ্মানদীর তলদেশ খনন করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন থেমে নেই। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী, চরচান্দ্র কাওলিপাড়া এলাকাসহ পদ্মাসেতুর দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই দিনরাত চলছে বালু উত্তোলন। এছাড়াও কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ইউনিয়নের পদ্মারচর এলাকার নদীবর্তী চর কেটেও মাটি নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পদ্মানদীর মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং, শরীয়তপুর এবং শিবচর সীমান্ত এলাকাতেও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এই বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।জানা গেছে, বর্তমানে অর্ধশত ড্রেজার বালু উত্তোলনের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পদ্মাসেতুর কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের কাউলিপাড়া এলাকার নদীর নতুন একটি চ্যানেলে মাধ্যমে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ড্রেজার দ্বারা উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেডে ভরে নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে। প্রতি ঘনফুট বালু পাইকারি বিক্রি করা হয় ৮০/৯০ পয়সা দরে। আর খননের জন্য ড্রেজার মালিক প্রতি ঘনফুটে পান ৬০ পয়সা। খুচরা বাজারে এই বালু বিক্রি হয় প্রতি ঘনফুট ১০/১২ টাকা দরে।ড্রেজারগুলো নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় এনে নদীতে বালু উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সময় অভিযানে শ্রমিকেরা আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে বালু বিক্রয়ের মূল হোতারা এবং ড্রেজার মালিকরা।এদিকে বিভিন্ন সময়ে পদ্মানদীতে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দ, জড়িতদের আটক এবং জরিমানা করা হলেও থেমে নেই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রেজার দিয়ে উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেড দিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয় এসকল বালু। এলাকায় ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় পদ্মার এই বালু এবং মাটি।শিবচর উপজেলার চরজানাজাত নৌ পুলিশ ফাঁড়ির আওতাভুক্ত থাকলেও নামে মাত্র মাঝে মধ্যে অভিযানের খবর পাওয়া যায়। এছাড়া, বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করে থাকে বলেও নৌপুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বাল্কহেড থেকেও চাঁদা আসে নৌপুলিশের হাতে। এছাড়াও প্রশাসনের 'অভিযান হবে' এমন খবরও নৌপুলিশের মাধ্যমেই বালু উত্তোলনকারীদের কানে পৌঁছে যায় বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।শিবচর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে গত ১১ সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুরে পদ্মাসেতু সংলগ্ন কাউলিপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত থাকায় দুটি ড্রেজার জব্দ করে প্রশাসন। এসময় দুইজনকে আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের ১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শিবচরের স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তি পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত ছিল। সে সময় রাতের বেলা এই সকল ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হতো। বিশেষ করে পদ্মা নদীবর্তী এলাকার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই কাজে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ব্যক্তি বিশেষের পরিবর্তন ঘটলেও নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের চাপে সাময়িক বন্ধ থাকলেও সুযোগ পেলেই শুরু হয় বালু উত্তোলন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আত্মগোপনে থাকলেও আরেকটি মহল বালু উত্তোলনের মহোৎসবে যুক্ত হয়েছে। শিবচর এবং লৌহজং এর কমপক্ষে অর্ধশত ড্রেজার বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।কাঁঠালবাড়ী ও চরজানাজাত এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি এশিয়ান টেলিভিশনকে জানান, শিবচর উপজেলার চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের পদ্মানদীতে জেগে উঠা নতুন চরের (বাঘরা সীমানা, চার নং পোল এলাকা) মাটি ড্রেজারের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। নতুন জেগে উঠা চর ফসল উৎপাদনের উপযোগী হলেও বালুখেকোদের কবলে পরে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে চরে চাষ করা ফসলসহ জমির মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিলেও তেমন কোনো প্রতিকার হয়নি বলেও জানা গেছে। গত ৫ আগস্টের আগে নিয়মিত এই সকল এলাকার চরের মাটি কেটে নিতো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। বর্তমানে তারা পলাতক রয়েছে।ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক ব্যক্তি বলেন, ৩৩টি ড্রেজারের কাগজপত্র (অনুমতি) আছে বালু তোলার। তবে বালু বিক্রয়ের অনুমতি নাই। আমারও একটা ড্রেজার চলে। আমি ৩ লাখ টাকা দিয়ে কাগজ কিনেছি। ৩৩টার বাইরেও ড্রেজার চলে। তবে প্রশাসন অভিযান করলে কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে সুযোগ পেলেই ড্রেজার চালায়।তিনি আরও বলেন, ড্রেজার থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরে বালু ফেলার নিয়ম থাকলেও বালু মূলত বাল্কহেড ভরে বিক্রি করা হয়। তবে অনুমতি কারা দেয় বা কাগজপত্র কিসের এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।এদিকে, উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে শিবচরের চরজানাজাত নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুস সালাম বলেন, গত তিন মাসে পদ্মানদী থেকে ২৪টি বাল্কহেড ও ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। আমরা খবর পেলেই অভিযান পরিচালনা করি। তাছাড়া সাধারণ মানুষ পুলিশ সম্পর্কে ওরকম একটু বলেই।শিবচরের চরজানাজাত নৌপুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। গত কয়েক মাসে অনেক ড্রেজার আটক করেছি। পদ্মা নদীর মাগুরখন্ড, কাওলিপাড়া এলাকায় ড্রেজারগুলো চলে। তবে অনেকেরই বালু তোলার কাগজপত্র রয়েছে।তবে পদ্মায় বালু উত্তোলনকারী সবগুলো ড্রেজারই অবৈধ বলে জানিয়েছেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, আমরা অভিযান পরিচালনা করি। গত বুধবারও ২টি ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। ১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। আমরা বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর অবস্থানে আছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে।