মধুপুর শালবনে অবমুক্তকরা ময়ূরগুলো বংশবিস্তার শুরু করেছে
হাবিবুর রহমান: কয়েকদিন ধরে মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম। বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মধ্যেই। এমন আবহাওয়ার মধ্যে গন্তব্য বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল মধুপুর গড়ে। মধুপুর শহর ৭-৮ কিলোমিটার দূরেই এ বন। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ পাকা সড়ক ধরে ১০ মিনিট গেলেই চোখে পড়ে বন। শালবনের বুক চিরে সড়কটি ছুটে গেছে ময়মনসিংহের অভিমুখে। ঘড়ির কাটায় আরো ১০ মিনিট গড়িয়েছে সড়কের দু’পাশের বন দেখতে দেখতে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটকে। মূল ফটকের সাথেই বন বিভাগের রেঞ্জ কার্যালয়। রেঞ্জের দায়িত্ব থাকা মোশারফ হোসেন এর সাথে কথা বলে জানা গেল শালবনের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত। এ রেঞ্জটি ১৬ হাজার ৬শ' ৬৬ দশমিক ৬৫ একর আয়তনের। সদর,গাছাবাড়ি,লহুরিয়া,রাজাবাড়ি ও বেরিবাইদ বিট নিয়ে গঠিত রেঞ্জে এখন প্রাকৃতিক শালবন টিকে আছে মাত্র ৫ হাজার একরের মতো। এছাড়াও সামাজিক বনায়নে ১৭শ' ১২ একর, বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ ৩০৫.৪০ একর, রাবার প্রকল্পে ৭০৮ একর এবং জবরদখল রয়েছে ৩২৩২.৮৯ একরের মতো।সাম্প্রতিক সময়ে মধুপুর শালবন পুনঃউদ্ধার প্রকল্পের আওতায় সীমানা চিহ্নিতকরণ, শালগাছের চারা রোপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ময়ূর ও কচ্ছপ অবমুক্ত করা হয়। গেল ২৫ মে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের ভেতরে নেটের খাঁচায় ২০টি ময়ূর ও একই স্থানেই পুকুরে ৫৪টি কচ্ছপ অবমুক্ত করেন। দুই মাসের মধ্যে ময়ূর ডিম ও বাচ্চা দিতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত দুইটি বাচ্চা ও ৬টি ডিম বাচ্চা ফুটানোর অপেক্ষায় রয়েছে। ২৮ দিন তা দেয়ার পর বাচ্চা ফোটবে বলে জানালেন রেঞ্জ কর্মকর্তা। এভাবে অবমুক্তকরা সব ময়ূর বাচ্চা দিতে থাকলে বাড়বে ময়ূর। পরে বনে অবমুক্ত করা হলে মধুপুর বনে আবার পেখম খোলে নাচবে ময়ূর এমনটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।১০ হাজার বর্গ ফুটের চিড়িয়াখানার আদলে করা খাঁচার চারদিকে জিআই নেটের বেড়া। এর মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা ময়ূরগুলোকে প্রতিদিন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইন্সের মাধ্যমে দেখাশোনা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এখন পর্যন্ত কোন অসুখ বিসুখ দেখা দেয়নি। আম, গাজর, মুরগির ফিড, গম, ন্যাচারাল পিঁপড়ার ডিমসহ নানা ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে।পরে টেলকি, রসুলপুর, গায়রা, কাঁকড়াগুণিসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং জীব বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী অনেকটাই কমে গেছে। মধুপুর জাতীয় উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী, হরেক প্রজাতির পাখি ও নানা প্রজাতির সরিসৃপ পাওয়া যেত। এর মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, লালমুখ বানর, মায়া হরিণ, শজারু বুনো শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে মেঘ হু, মাছরাঙা, গোছা পেঁচা, বনমোরগ প্রভৃতি। এছাড়াও, এক সময় মধুপুর গড়ে চিতা বাঘ ও ময়ূরের বিচরণ ছিল বলে জানা গেছে।এ বনের হারিয়ে যাওয়া ময়ূর আবার ফিরে আসলে বাড়বে প্রাণী বৈচিত্র্য। মধুপুর বন ফিরে পাবে তার হারনো গৌরব আর আদি ঐতিহ্য, এমনটাই মনে করেন স্থানীয়রা ।টাঙ্গাইল বনবিভাগের রসুলপুর সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জানান, শালবন পুনঃউদ্ধার কার্যক্রম চলমান। শালগজারি ও শালসহযোগী বহেড়া, নিম, হরতকিসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার লহুরিয়ায় অবমুক্ত করা ময়ূর ইতিমধ্যে দুইটি বাচ্চা ও ৬টি ডিম দিয়েছে। ডিমগুলো বাচ্চা ফোটানোর অপেক্ষায় রয়েছে। বর্ষা মৌসুমের পর হয়তো আরও ভালো উপযোগী পরিবেশ হবে তখন ময়ূরের সংখ্যা বাড়তে পারে।তবে স্থানীয়রা মনে করছেন, সামাজিক বনায়নে শালগজারি বৃক্ষ রোপণের মধ্যে দিয়ে টেকসই বন ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে এসে শালবনের হারানো ঐতিহ্য আনা দরকার। ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ বাড়ছে বাণিজ্যিক চাষাবাদে, সে দিকে নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের এমনটাই বলছে গড়বাসী।