• ঢাকা
  • |
  • শনিবার ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১ সন্ধ্যা ০৭:৫৩:৪৭ (27-Apr-2024)
  • - ৩৩° সে:
এশিয়ান রেডিও
  • ঢাকা
  • |
  • শনিবার ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১ সন্ধ্যা ০৭:৫৩:৪৭ (27-Apr-2024)
  • - ৩৩° সে:

অধ্যাপক মো. ইউনুস : একটি নাম একটি ইতিহাস

মোহাম্মদ আবদুল অদুদ: কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং ও ব্রাক্ষণপাড়া উপজেলা) নির্বাচনী এলাকার কীর্তিমান রাজনীতিবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ, বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সফল জাতীয় সংসদ সদস্য মরহুম আলহাজ্ব অধ্যাপক মো. ইউনুসের কথা বলছি। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা-৫ আসন থেকে চার বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে এ অঞ্চলের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যা দৃশ্যমান নয়, জনগণের সাথে কানেক্টিভিটি, সেটার অনন্য উদাহরণ ছিলেন অধ্যাপক মো. ইউনুস।অধ্যাপক মো. ইউনুস ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই বুড়িচং উপজেলার পীরযাত্রাপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মিয়া বংশের মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মো. চান্দ মিয়া মুন্সী এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। তিনি মেট্রিক্যুলেশন পাসের পরপরই পার্শ্ববর্তী শিবরামপুর গ্রামের প্রভাবশালী, সম্ভ্রান্ত ও বুনিয়াদী পরিবার হাজী নজিমউদ্দিন ও জিনাতুন্নেসা বেগমের কনিষ্ঠ কন্যা লুৎফুন্নেসা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।অধ্যাপক মো. ইউনুস ২০২১ সালের ২৭ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ২০১২ সালের ২২ জুলাই ঢাকার অদূরে ভুলতা নামক স্হানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে অধ্যাপক মো. ইউনুস ও লুৎফুন্নেসা বেগম ২ মেয়ে, ২ মেয়ের জামাই, ৫ পুত্র, ৫ পুত্রবধূ এবং ১৫ জন নাতি-নাতনী, অসংখ্য আত্মীয়স্বজন এবং হাজারো ভক্ত ও অনুসারী রেখে গেছেন।অধ্যাপক মো. ইউনুস শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও কৃতি ছাত্র ছিলেন। তিনি গোপীনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্রীপুর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা ও বুড়িচং জুনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনা করেন। তিনি প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সাথে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ১৯৬০ সালে পুর্ব বাংলার একমাত্র ঢাকা বোর্ডে কুমিল্লা হোচ্ছামিয়া বাই মাদ্রাসা থেকে মেট্রিক্যুলেশন পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে মেধা তালিকায় ১২তম স্হান অধিকার করেন। তারপর শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে আইএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনস্থ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি সম্মান (গণিতে) কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। তিনি ১৯৬৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে মেধা তালিকায় প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি পাস করেন।  অধ্যাপক মো. ইউনুসের ছিল সুদীর্ঘ ৬০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, যা কুমিল্লা-৫ নির্বাচনী এলাকার জন্য একটি মাইলফলক। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৮ সালের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি জগতপুরের আবদুল মোতালিবের মটর সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হাজির হন।তিনি ১৯৬২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ স্টুডেন্ট লীগের সক্রিয় সদস্য হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এইসময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করেছেন। তিনি ১৯৬৫-৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি শহীদউল্লাহ হল (তৎকালীন ঢাকা হল) শাখা ছাত্রলীগের নির্বাচত সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ও ডাকসুর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসাবে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৮ সালের ১১ দফা আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক ও জনতাকে সম্পৃক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।তিনি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশ রক্ষায় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যার কারণে পাক হানাদার বাহিনী বুড়িচংয়ে সর্বপ্রথম তাঁর গ্রামের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং পরিবারের কাউকে না পেয়ে নিকটাত্মীয়দের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন করে এবং তাদেরকে ঘর ছাড়া করে।অধ্যাপক মো. ইউনুস স্বাধীনতা যুদ্ধে তদানীন্তন জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট আহাম্মদ আলী ও অধ্যাপক মো. খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে গঠিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার ইস্টার্ন কমান্ড কাউন্সিল কতৃক পরিচালিত বক্সনগর ও পদ্মনগর ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডেপুটি-ইন-চার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত তিনি ও প্রিন্সিপাল আবদুর রউফ বাংলার মুক্তিকামী ছাত্র ও যুবকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্হা করেন। তিনি বাংলাদেশের সীমান্তে টহলরত ও ব্যাংকারে আশ্রিত পাক হানাদার বাহিনীর উপর ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম ও ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী কতৃক পরিচালিত সাঁড়াশী অভিযানে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য ক্যাম্পের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের নিয়োজিত করেন। অধ্যাপক মো. ইউনুস পদ্মনগর শরণার্থী রিসিপশন ক্যাম্পেরও ডেপুটি-ইন-চার্জ ছিলেন। ভারতে স্থাপিত শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে অন্যতম ছিল এটি। তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাড়ি দেয়া হাজার হাজার শরণার্থীর রিসিপশন এবং ক্যাম্পে পুনর্বাসনের দায়িত্ব পালন করেন।অধ্যাপক ইউনুস ছিলেন স্বাধীনতাত্তোর বুড়িচং ও ব্রাক্ষণপাড়া উপজেলার উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আজীবন এলাকার উন্নয়নে ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বুড়িচং এনে কুমিল্লা থেকে মিরপুর অবধি মেজর আবদুল গনি সড়ক প্রথম পাকা করার ব্যবস্থা করেন। বুড়িচং আনন্দ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও ব্রাহ্মণপাড়া ভগবান উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন এবং বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের কিংবা স্ত্রীর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি তার পুত্র-কন্যা কাউকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেননি এবং তাদের কাউকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অবৈধ উপার্জনের সুযোগ করে দেননি। তিনি সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতা কর্মীদের কাউকে টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতি করতে প্রশ্রয় দেননি। তিনি সরকারি কাজে নিয়োজিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে কারোর জন্য অন্যায় ও অবৈধ আবদার নিয়ে যেতেন না কিংবা সুপারিশ করতেন না। তিনি কারো কোনো উপকার করতে না পারলেও তাঁর মাধ্যমে কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে, এই কথা কেউ বলতে পারবেন না।অধ্যাপক মো. ইউনুস ছিলেন তীক্ষ্ণ মেমোরির অধিকারী। তিনি বুড়িচং ও ব্রাক্ষণপাড়ার ১৭টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষের নাম, বাবার নাম ও পরিচয় জানতেন। তিনি দিনের ২৪ ঘণ্টাই তার ব্যক্তিগত ফোন খোলা রাখতেন এবং মানুষের ফোন রিসিভ করে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনে তাঁর পক্ষে সম্ভব সবরকমের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এবং আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তারপরও তিনি দমে যাননি বা প্রতিশোধপরায়ণ হননি। সামনে থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জনগণের সেবা করেছেন। তিনি দল, মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য কাজ করেছেন। সম্পূর্ণ নিরহংকারী অধ্যাপক মো. ইউনুস সুন্দর ব্যবহার, নীতি ও নৈতিকতা এবং উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের মনের মণিকোঠায় চিরস্হায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।পরিশেষে বলা যায়, অধ্যাপক মো. ইউনুস একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর প্রতি জনগণের এবং জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত। এই জনপদের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে স্মরণে রাখবে যুগ যুগ ধরে। মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করি।লেখক : সাংবাদিক ও সদস্য, অধ্যাপক মো. ইউনুস ফাউণ্ডেশন

জেলার ইতিহাস


দর্শনীয় স্থান