নিজস্ব প্রতিবেদক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই সারাদেশ এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ছোট বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ৩০০ আসনের মনোনয়নপত্রও বিতরণ শুরু করেছে। অন্যদিকে বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের কথা জানালেও তলে তলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০০৮ সালে নবম সংসদ এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বয়কটের ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণ করেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এমনটি হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, নবম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি,কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ভোটে আসে বিএনপি। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। সেসময় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অনুরোধ করেছিলেন দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার দুই ছেলে তারেক রহমান ও কোকোকে যেনো বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ার অনুরোধ নাকচ করে দেয়। ফলে ছেলেদের মুক্তি ব্যতীত খালেদা জিয়া তার দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর জন্য খালেদা জিয়া ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্থ তারেক রহমান ও কোকো আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে লন্ডনে চলে যায় এবং বিএনপি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
এ প্রসঙ্গে 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)' শিরোনামের বইতে বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ উল্লেখ করেছেন যে, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরব ছিল বিএনপি। সেসময় তারা প্রথমে দাবি করেছিল, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু সংবিধান মোতাবেক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থানের ফলে এক পর্যায়ে বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট জোট গঠন করা হয় এবং সে নির্বাচনেও বিএনপি অংশগ্রহণ করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর নির্বাচনের ফলাফল বয়কট করেছিল বিএনপি। কিন্তু সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে ৬ নির্বাচিত ও ১ জন সংরক্ষিত মোট ৭ জনকে সংসদে পাঠিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরবর্তীতে সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে ৭ জন সংসদ সদস্যই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং দলীয়ভাবে বিএনপি রাজপথেই সকল দাবির উপর আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঈদের পর আন্দোলন, ৩১ দফা, ১৪ দফা, ৪ দফা, ১ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েও জনসম্পৃক্ততা না থাকায় সকল আন্দোলনেই ব্যর্থ হয় বিএনপি। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের দাবিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলন করে বিএনপি। কিন্তু তাতেও আন্দোলনের ফলাফলের দিক থেকে তেমন সুবিধা করতে পারেনি তারা।
অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বিএনপি রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের দিকে ধাবিত হলেও সেখানেও ব্যর্থ, আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সংসদেও তাদের প্রতিনিধি থাকবে না। এমতাবস্থায় দলটি অস্তিত্বসংকটে পরবে তা দলের শীর্ষ নেতাদের সবারই জানা। তাই বিএনপি এই মূহূর্তে সকলের অগোচরে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করছে অনেকেই।
এব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরের শুরু থেকেই দেশে বিদেশি তৎপরতা ছিল চোখে পরার মতো। একের পর এক পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিএনপি প্রীতিও এখন কারো অজানা নয়। রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতাদের সাথে, এমনকি সরকারকে চাপে ফেলতে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সকল পদক্ষেপেই ব্যর্থ হয়েছে বিদেশিরা। দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে অনড় অবস্থানে রয়েছে সরকার।
সর্বশেষ শর্তহীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধার আওতায় আসতে পারছে না বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের সময় ফুরিয়ে গেছে বলে সংলাপের আহবানকে প্রত্যাখান করা হয়েছে। বিদেশি তৎপরতার সকল চেষ্টাই আপাতত শেষ বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিএনপি এতদিন যে বিদেশিদের ঘাড়ে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল সে আশারও গুড়েবালি। তাই এই মুহূর্তে সকল পরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে যে গুঞ্জনটি শোনা যাচ্ছে, তা একেবাড়ে উড়িয়ে দেয়ার মতো সুযোগ নেই।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনের তারিখ আরও ১১ দিন পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করতে পুণরায় তফসিল ঘোষণা করা হয়। একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, ৮ নভেম্বর ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের দাবির প্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর পুনঃতফসিলে তা পিছিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর নির্ধারিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংবাদিক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, ‘তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, বিএনপির বোধহয় আর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এরকম ভাবার কোন অবকাশ নেই। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে এবং পুনঃ তফসিলের আবেদন করে তাহলে অবশ্যই তাদের আবেদন বিবেচনাসাপেক্ষে ভোটের দিন নতুনভাবে নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, বিএনপি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার একটা শক্ত কারণ হচ্ছে, যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বহু নেতাই তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেবে। তৃণমূল বিএনপি ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী দেবার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়াও বিএনপি ভেঙ্গে বিএনএফ, স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ নামের আরো কয়েকটি দল গঠিত হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে বিএনপিরই সাবেক নেতারা। এ দলগুলোও আসন্ন নির্বাচনে জোটগতভাবে কিংবা স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে অধিকাংশ নেতাকর্মীই এসকল দলের হয়ে নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে যে খবরটি চাউর হচ্ছে, তা আসলেই যৌক্তিক।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2023, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available