তিতুমীর কলেজ প্রতিনিধি: প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ তারপর এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। নতুন বাংলাদেশের বার্তা নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্র-জনতা। যেখানে সত্য মাথা তুলে দাঁড়ায় হিমালয়ের মতো, সেখানে বিজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও, পরবর্তীতে তা স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যার মূল লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারী সরকারকে তার গদি থেকে হটানো। এই আন্দোলনটি কেবল একটি নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশার প্রতিফলন।
২৪ এর এই অভ্যুত্থানে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মহাখালী এলাকায় ব্যাপক প্রতিরোধ করে দিলে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ফ্যাসিবাদ সরকারের রাতের ঘুম হারাম করে। মহাখালী, গুলশান, বনানী এই শহরগুলোতে সাধারণত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অবস্থান করে আর এই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রুপে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে । তার সাথে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পথ, রেল পথ মহাখালীর উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। আর এটাই হয়ে উঠে আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
তিতুমীর কলেজের একজন শিক্ষার্থী নোমান আল নীরব জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ৬ জুলাই পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো তিতুমীর কলেজের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে মূল প্রোগ্রামে যুক্ত হতে রওনা হই। বাংলামোটর থেকে শুরু হওয়া ছাব্বিশজনের এই ঐতিহাসিক বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ, টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শত শত তিতুমীরিয়ানের মিছিলে পরিণত হয়। ইতিপূর্বে চার দফা দবির পরিবর্তে আমাদের দেওয়া একদফা দাবির প্রতি ফ্যাসিস্ট হাসিনা কোনো জবাব না থাকায় এদিন সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলা এই আন্দোলনের হাজারো পার্সপেক্টিভের গল্প আছে। তবে মহাখালীর একটা প্রতিষ্ঠান শত শত শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে আন্দোলনে যুক্ত হওয়া বেশ চমকপ্রদ ছিল এবং হালকা ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলনকে তাৎক্ষণিকভাবে চাঙা করে তোলে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বাংলার ভূখণ্ডে নতুন প্রজন্মরা এইরকম অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনো হয়নি। এই আন্দোলনের এক একটি স্লোগান ছিল নতুন অধ্যায়ের সম্ভাবনার প্রতীক। তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য কেন্দ্র করে," তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার " স্লোগানে ১৪ জুলাই মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারাদেশ। বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর ইত্যাদি সহ কাজী নজরুলের সেই অগ্নিঝরা গানগুলো এই আন্দোলনের সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে।
তিতুমীরের আরেক শিক্ষার্থী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক নীরব হাসান সুজন বলেন, ৪ জুলাই ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে সেটার সূচনার শুরুতে তিতুমীর থেকে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপ গুলো আস্তে আস্তে বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল। ইনশাল্লাহ যখনই বাংলার জমিনে ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে তখন আবারো এই রাজপথে নেমে আসবে তিতুমীরের সন্তানেরা।
সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য মোহাম্মদ মেহেদী হাসান মাল বলেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনে একদিন করছিলাম রামপুরা-মালিবাগ-আবুল হোটেল মোড়ে।সেদিন ছিল শুক্রবার। জুম্মার নামাজ শেষে মাঠে এসে দাঁড়ালাম— সাথে হাজার হাজার জনতা। দাঁড়িয়ে ছিলাম বেটার লাইফ হাসপাতালের সামনে। হঠাৎ দেখি কেউ একজন লাশের খাট নিয়ে আসছে। তখনও আন্দোলন শুরু হয়নি মাত্র নামাজ পড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। লাশ বহনকারী ভাইদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“ভাই, কীসের লাশ?” তারা বললো,‘১৮ জুলাই বি-টিভি সেন্টারে আন্দোলনের সময় এখানেই একজন শহীদ হয়েছেন।পুলিশের জন্য লাশ রুমে ছিল, ভয়েই বের করতে পারেনি।এখন এত জনতা দেখে লাশ বের করে এনে বেটার লাইফে পোস্টমর্টেম করাতে এনেছে।”কথাটা শুনে শরীর হিম হয়ে গেলো।
যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা আন্দোলন করবো। সেখান থেকেই গতকাল লাশ হয়ে ফিরেছেন এক ভাই। কিছুক্ষণ পর লাশটি আবার বের করে নিয়ে যাওয়া হলো।
পোস্টমর্টেম শেষ। সামনে শোক, পেছনে প্রতিশোধের আগুন।
এসব আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট, ২০২৪ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এটি "কোটা সংস্কার আন্দোলন" নামে পরিচিত একটি ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি।
এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সরকারের পতনের পাশাপাশি জন আন্দোলনের শক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available