নিজস্ব প্রতিবেদক: একের পর এক দেশের সঙ্গে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত যুক্তরাষ্ট্র। ‘বাধানো’ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন আমেরিকার সৈন্যসহ অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক। এনিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন খোদ মার্কিন নাগরিকরা। তবে তাতে তোয়াক্কা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের নানা বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা সরব ভূমিকা পালন করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ যুদ্ধ নিয়ে কোনো টুঁ শব্দ করছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশে যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশের অর্থায়নে কাজ করেন। সুতরাং মানসিকভাবেই তারা পশ্চিমাজগতে বাস করেন।
হঠাৎ করেই শুরু হওয়া ফিলিস্তিন-ইজরায়েল ‘যুদ্ধ’ বিষয়ে মানবাধিকারের কথা না বললেও যুদ্ধে জয়ী হতে সরাসরি ইজারায়েলকে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে ইজরায়েলকে সহায়তা দেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মদদে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অধিকাংশ যুদ্ধের আইনি ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আইনি বিশ্লেষকরা।
একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫৩টি অঞ্চলে সংঘটিত ২৪৮টি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে ২০১টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত ছিল, যা মোট সংখ্যার ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বৈধ পদ্ধতির’ মাধ্যমে চালিয়েছিল যা তারা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে অনুমোদনের জন্য জাতিসংঘকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এর বেশির ভাগই ছিল মানবাধিকারের নামে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে শুরু করা অবৈধ যুদ্ধ।
২০০৪ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ইরাক যুদ্ধ নিয়ে অনেক সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে 'সামঞ্জস্যপূর্ণ' নয়। নিরাপত্তা পরিষদের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধে যাওয়ার পদক্ষেপের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। শুধু তাই নয় ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ইরাকে ঠিকাদারি কর্মকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত থাকার সময় এক ঠিকাদারের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার গ্র্যাচুইটি গ্রহণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে।
আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দীর্ঘ ও ভিত্তিহীন’ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ এবং মার্কিন সংবিধান লঙ্ঘন করে অঘোষিত যুদ্ধ বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই যুদ্ধগুলো রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক উভয় দলের এবং আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম দ্বারা ব্যাপকভাবে সমর্থিত ছিল। তার আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বিতর্কিত হাতিয়ার হচ্ছে ড্রোন হামলা। নিউইয়র্ক টাইমস এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে বলেছিল ড্রোন হামলায় কে মারা যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই! যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসেও এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। কেউ কেউ এটাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বলেছে, গতবছরের মে মাসে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক শিরিন আবু আকলা হত্যার নিন্দা জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়সহ একাধিক স্বাধীন তদন্তে দেখা গেছে, একজন ইসরায়েলি সৈন্য তাকে হত্যা করেছে। গত বছরের নভেম্বরে এফবিআই তার মৃত্যুর তদন্ত শুরু করে। ইসরায়েল গত সেপ্টেম্বরে স্বীকার করে যে আবু আকলা সম্ভবত একজন ইসরায়েলি সৈন্যের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তবে যদি তাই হয় তবে এটি দুর্ঘটনাজনিত এবং তারা মার্কিন তদন্তে অংশ নেবে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন গুয়ানতানামো বে-তে অবস্থিত মার্কিন সামরিক কারাগার বন্ধ করার অঙ্গীকার করলেও ৩৬ জন বিদেশি মুসলিম এখনো রয়ে গেছেন, যাদের অধিকাংশই দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই আটক রয়েছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলায় অভিযুক্ত পাঁচ গুয়ানতানামো বন্দির বিচার ত্রুটিপূর্ণ সামরিক কমিশনে স্থগিত করা হয়েছিল। আসামিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ দোষীদের আবেদনের বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিলেন।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের ইস্যু তুলে বারবার সরকারকে কাঠগোড়ায় তোলার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল আগ্রাসনসহ নানা মানবাধিকারহরণ করা ঘটনায় নীরব যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত কয়েকশত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে শিশু-নারীদের। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিশ্চুপ ওয়াশিংটন, তবে ইজরায়েলকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ’র মতে, বেশিরভাগ যুদ্ধই আইনসিদ্ধ না। তিনি বলেন, ‘যেভাবে সাধারণ জনতাকে বিশেষ করে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া কঠিন। মুসলিম উম্মাহ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আমাদের দরদ ও সহানুভূতি বেশি। নিকট অতীতের ২০০৮, ২০১৪ এবং বর্তমান ইসরায়েলি আগ্রাসনকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে বারবার। অবশ্য হামাসের কর্মকান্ড ও হামলাকেও অনেক অর্থেই বৈধ বলা যাবেনা।’
তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ আন্তর্জাতিক আইন বিশ্লেষকরা মনে করেন যে গত কয়েক দশক ধরে, অকুপেশন ফোর্স হিসেবে, ইসরায়েল যে আধিপত্যমূলক বসতি নীতি অনুসরণ করে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইয়াহুদীদের আবাসন কায়েম করেছে তা আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের লঙ্ঘন। সমগ্র জেরুজালেমকে রাজধানী করে ইসরায়েল তাঁর ষোলোকলা পূর্ণ করতে চায়, যা আমেরিকাসহ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া অনুমোদন করে না। জাতিসংঘও এমন আইডিয়া সমর্থন করেনা। এমন ধারণা নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশনেরও লঙ্ঘন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড খুবই খারাপ। ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে যত যুদ্ধ হয়েছে কোনটাই তো আইনসিদ্ধ না। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ কিংবা কোথাও যুদ্ধগুলো পাশ করে করা হয় নাই। সরাসরি প্রেসিডেন্টের অর্ডারের যুদ্ধ পরিচালনা হয়েছে। কোরিয়ান যুদ্ধে কিছুতা জাতিসংঘের সায় ছিল। কিন্তু সেটি বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোন যুদ্ধে সফল হয়নি।’
তিনি বলেন, প্রতিটি যুদ্ধ ছিল আইন বহির্ভূত। প্রতিটি যুদ্ধে আইন বহির্ভূতভাবে বাজেট ছিল। এমনকি আফগানিস্তানে গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ ছিল বলেই আইসিসি’র জারা জুরি ছিলেন, বিশেষ করে জিনি প্রসেকিউটর ছিলেন তাকে আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আমাদের জারা মানবাধিকার কর্মী আছে তার এগুলো নিয়ে কথা বলবে না। কারণ বাংলাদেশে যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশের অর্থায়নে কাজ করেন। সুতরাং মানসিকভাবেই তারা পশ্চিমাজগতে বাস করেন।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available