ইবি প্রতিনিধি : কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কালো, শোকের প্রতীক। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুলের রঙ লাল যা শহীদের লাল রক্তের প্রতীক। এজন্যই কবি শামসুর রহমান লিখেছেন–‘আবার ফুটেছে দেখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়– ফুল নয়, ওরা শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর। একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।’
রঙ ছড়াচ্ছে ফুল, হাসছে প্রকৃতি—ঋতুর মেলা গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহেও প্রকৃতি যেন প্রাণ খুঁজে পেয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ক্যাম্পাসে। কৃষ্ণচূড়ার রক্তলাল রঙের সঙ্গে মিলেছে হলুদ সোনালু আর বেগুনি জারুল। সবুজ ক্যাম্পাস সেজেছে লাল, হলুদ ও বেগুনি রূপে। প্রকৃতিই যেন বহন করছে জুলাই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের রক্তমাখা স্মৃতি।
গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ, প্রখর রৌদ্র আর তপ্ত বাতাসে যখন পুড়ছে প্রকৃতি তখনই বাহারি ফুলগুলো নিজেদের মেলে ধরেছে স্বমহিমায়। গাছের ডালে দুলতে থাকা ফুলের পাপড়ি আর হালকা বাতাস যেন গ্রীষ্মের ক্লান্তিতে এক প্রশান্তি এনে দিয়েছে। রোদের তীব্রতাকে ছাপিয়ে চক্ষু শীতল করছে শিক্ষার্থী-দর্শনার্থীদের।
রুক্ষ-শুষ্ক এই মৌসুমে শিক্ষার্থীদের মনকে শীতল পরশ দিতে বরাবরের মতোই প্রধান ভূমিকায় আছে কৃষ্ণচূড়া। রক্তিম রঙে রাঙানো এই লাল শুধু ফুলের রঙ নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতীক, সাহসের প্রতিধ্বনি। ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) চারপাশকে সাজিয়ে রেখেছে কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। বিকেল হতেই শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে স্থানটি। ছবি তোলার উৎসবস্থল হয়ে উঠে টিএসসির কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো।
এছাড়াও প্রশাসন ভবন, স্মৃতিসৌধ এলাকা, রবীন্দ্র-নজরুল কলাভবন, মীর মোশাররফ হোসেন অ্যাকাডেমিক ভবন, খালেদা জিয়া হল, উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হল, শাহ আজিজুর রহমান হলসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণচূড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে অনন্য এক সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে।
চিরসবুজ এই ক্যাম্পাসে গ্রীষ্ম এলেই রঙের উৎসব শুরু হয়। কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা যেন আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেগুনি পাপড়ির কোমল শোভায় ফুটে উঠে জারুল।
এই রঙিন প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় সোনালু ও কনকচূড়া। সোনালুর ঝুমকা ঝুলে থাকা ফুলগুলো যেন সোনার মালা, যা ডায়না চত্বরকে করে তোলে মায়াবী। কনকচূড়ার উজ্জ্বল হলুদ ফুলগুলো মাথা উঁচু করে টিএসসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এ যেন পথিকের জন্য এক হলুদ ছাতা। সবুজ ঘাসের কার্পেটের উপর লাল, হলুদ আর বেগুনি রঙের এমন সান্নিধ্য প্রকৃতির এক অনুপম উপহার, যা দেখে মন ভরে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আল ফিকহ্ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস মীম বলেন, "আমি বরাবরই ফুলপ্রেমী। প্রতিদিন ডায়না চত্বর, লাইব্রেরীসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনের পাশ দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে চোখে পড়ে সোনালুর ঝুলে থাকা ঝুমকা ফুল, কৃষ্ণচূড়া ও জারুল। গ্রীষ্মের রুক্ষতা আর ব্যস্ততার মাঝে এই সোনালি ঝরনাধারার মতো ফুলগুলো এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। যেন প্রকৃতির কোলে বসে কিছুক্ষণ ছায়া খোঁজার এক শান্ত অভিজ্ঞতা। চেরি ব্লোসম যেমন জাপানের বসন্তের রূপকথা, তেমনি কৃষ্ণচূড়া আমাদের গ্রীষ্মের আবেগ আর প্রতিবাদের প্রতীক। দুটি ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ঋতুতে একটি কোমলতা ছোঁয়ায়, অন্যটি দীপ্ত আগুন। তবুও স্মৃতির পাতায় তারা একসঙ্গে ফুটে থাকে চিরকাল।"
একই বিভাগ ও শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম বলেন, "ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এই মুহূর্তে কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম রঙে রাঙানো। প্রকৃতিই যেন স্মরণ করছে জুলাই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগ। এই লাল শুধু ফুলের রঙ নয়, বরং প্রতিরোধের প্রতীক, সাহসের প্রতিধ্বনি। প্রকৃতির এই রঙিন প্রশান্তি আমাদের ক্লান্ত মনে জাগিয়ে তোলে নতুন আশার আলো। এমন পরিবেশ শুধু শিক্ষা নয়, ইতিহাস ও মনন বিকাশেও অনুপ্রেরণা যোগায়।"
প্রতি গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়া তার অগ্নিময় রঙে ক্যাম্পাসকে সজ্জিত করে, কিন্তু এবারের রঙ যেন আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল, আরও জীবন্ত। যেন এই লাল সৌন্দর্য এক নতুন শপথে ফিরে এসেছে সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। প্রতিটি সকাল-বিকেল রাঙানো থাকবে শহীদদের আত্মত্যাগের রক্তিম স্মৃতিতে। যা আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস পরবর্তীতে এক নতুন শক্তি যোগায়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি মুহূর্ত তাদের সাহসের আলোতে ঝলমল করবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available