চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের শুরুর কথা
হাসনাত হাসান রাহাত: আজ ১৮ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। এ দিবসটি জাদুঘরের সময়ের বিবর্তন ও গুরুত্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। জাদুঘরের যাত্রার ইতিহাস বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, Princess Ennigaldi-Nanna’s Museum এর কথা। যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ সালে। বর্তমান এটি দক্ষিণ ইরাকের উর শহরে বা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় অবস্থিত। বর্তমানে এ জাদুঘরের অবস্থা আর মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সময়ের মতো নেই। এটি এখন জরাজীর্ণ।Princess Ennigaldi-Nanna’s Museum এর হাত ধরেই মূলত জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর আমাদের সামনে আসে প্রাতিষ্ঠানিক জাদুঘরের কথা। প্রাতিষ্ঠানিক জাদুঘর বলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমির পাশাপাশি গবেষণা ও অনুসন্ধানের জন্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৈরি 'জাদুঘর'। একাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক জাদুঘরের কথা বললে প্রথমে আসে, Ashmolean Museum, Oxford এর কথা। এটি ১৬৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। এর ধারা বা প্রভাব এসে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক জাদুঘর। যার সূচনা হয় ১৯৭৩ সালের১৪ জুন, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক আবুল ফজলের হাতে। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল করিম এবং শ্রদ্ধেয় আজিজুর রহমান মল্লিক। প্রথমে জাদুঘর হিসেবে পুরাতন কলা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি রুমকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তখন সেখানে প্রদর্শনের জন্য ৩০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এর সংগ্রহ বাড়তে থাকলে স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। ১৯৮৩ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর’ নাম পায়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে এম এম আলী রোডের জিলা শিল্পকলা একাডেমী হয়ে ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবন ঘুরে বর্তমান গ্রন্থাগার সংলগ্ন স্থানে স্থায়ী খুঁটি গাড়ে ১৯৯২ সালে। প্রাথমিকভাবে এটি ইতিহাস শিক্ষার সহায়ক উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও পরবর্তীতে এটি বৃহৎ আকারে একটি সাংগঠনিক ও শৃঙ্খলিত জাদুঘরে রূপ নেয়। বর্তমানে এটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাকেন্দ্রিক জাদুঘর নয়, বরং ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান ও জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল সংগ্রহশালা। জাদুঘরটির সংগ্রহে রয়েছে – প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটির মূর্তি, নৌকার অংশবিশেষ, ঐতিহাসিক দালিলিক নথি, অস্ত্র ও সামগ্রী, চিঠিপত্র, প্রত্নবস্তু, আরব, পারস্য, মোগল ও ব্রিটিশ আমলের সামগ্রী, পাণ্ডুলিপি ও চিত্রশিল্প। প্রায় ১,৩১৮টি প্রদর্শনযোগ্য বস্তু রয়েছে এ জাদুঘরে।এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পিছনে 'ইতিহাস বিভাগের' ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ১৯৬৭ সালে ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে এবং শিক্ষক ড. আবদুল করিমের নেতৃত্বে বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের নিয়ে চট্টগ্রামের বর্তমান মীরসরাই উপজেলার পরাগলপুরে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন-শিলালিপি, স্থাপত্য নিদর্শন ও একটি মসজিদের মিহরাব খুঁজে পান। পরবর্তীতে এসব নিদর্শনকে ঘিরেই যাত্রা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর।‘আন্তর্জাতিক কাউন্সিল অব মিউজিয়ামস’ এর ঘোষণায় বলা হয়েছে, “জাদুঘর কেবল অতীতের স্মারক সংরক্ষণ নয়, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি সক্রিয় অংশীদার”। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরও একটি সক্রিয় শিক্ষাবান্ধব ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে।লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।