নরসিংদী প্রতিনিধি: নরসিংদীর সদর হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। হাসপাতালের মূল গেট থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, আউটডোর, ডাক্তারদের রুমের পাশের দরজা, সব জায়গায় ওদের অবাধ বিচরণ। রোগী এলেই তারা হামলে পড়ে, দেখায় বিভিন্ন প্রলোভন। অনেকটা সবার চোখের সামনেই চলে দালাদের এই তৎপরতা।
এর পিছনে কারণ একটাই। নরসিংদী সদর হাসপাতালের গেটের সামনে, পিছনে পুরো এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বৈধ অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। তারা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সদর হাসপাতালে অবস্থান করে এবং রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে যায় ক্লিনিক বা ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোতে, এর বিনিমযয়ে পায় মোটা অংকের কমিশন। এমনকি ওষুধ কিনতে হলেও তাদের পছন্দের দোকান থেকে কিনতে হয়। হাসপাতালগুলোতে তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। দালালদের ওপর সদর হাসপাতাল প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়া দালালদের মদদ যোগায় হাসপাতালেরই দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মচারী। ফলে দালাল চক্রের কাছে সাধারণ রোগীরা জিম্মি।
নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা থেকে সদর হাসপাতালে মো. রাকিবুল ইসলাম চিকিৎসা নিতে এসে বলেন, ‘সদর হাসপাতালে এসেছিলাম, এ জায়গায় ভালো চিকিৎসা হবে সেই আশায়। কিন্তু এসে দেখি চিত্র পুরোই ভিন্ন। এ জায়গায় টিকেট নিতে গেলেও আশেপাশের কয়েকজন এসে বলে, ভাই, ৫০ টাকা বাড়তি দেন, লাইনে দাঁড়াতে হবে না। তারপরেই তারা বলতে শুরু করেন, এই জায়গায় ডাক্তার ভালো না, সুন্দর করে রোগীদের দেখে না, ভালো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। পাশে অনেক ভালো ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সেখানে উন্নত মানের চিকিৎসা করা হয় ভালো ডাক্তারের মাধ্যমে। আরো কত কী প্রলোভন!’
নরসিংদী সদরের বিথি রানী এক সন্তানের জননী, তার বাচ্চাকে ডাক্তার দেখাতে এসে বলেন, ‘সকালে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই একজন মহিলা আমাকে বললেন, আপনার মেয়েকে এর থেকেও ভালো ডাক্তার দেখানো যাবে। এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ডাক্তার কোনো কিছুই ভালো না। আমার সাথে চলুন, অনেক ভালো ডাক্তার দেখানো হবে। এ কথায় বিশ্বাস করে আমি তার সাথে যাই। ওই মহিলা আমাকে একটি ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। প্রথমেই আমার থেকে ডাক্তারের ফি নেয় ৫০০ টাকা। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার দেখে এবং একগাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ওই মহিলাই সেই ডায়গনস্টিক সেন্টারের কাউন্টারে নিয়ে যায় এবং হিসাব-নিকাশ করে দেখে সাড়ে তিন হাজার টাকা পরীক্ষার বিল। আমি বলি, পরীক্ষা করাবো না। হাতে এত টাকা নেই। কিন্তু তাৎক্ষণিক তারা বিভিন্ন ভয় দেখায় আমাকে। এখন না করলে আমার মেয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে। তার পেটের সমস্যা নাকি গুরুতর। শেষে আমি বাধ্য হয়ে বাসা থেকে টাকা আনিয়ে পরীক্ষা করে ডাক্তার দেখাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়। এতকিছু করার পরও আমার মেয়ের অসুখটা সুস্থ হয় নাই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, ‘জরুরি বিভাগ, হাসপাতালের গেইট, ডাক্তারদের রুমের পাশেসহ পুরো হাসপাতাল জুড়েই মহিলা ও পুরুষ দালালের দৌরাত্ম্য রয়েছে। আমরা যা ইনকাম করি, তারা আমাদের থেকে অন্তত দশগুণ বেশি টাকা ইনকাম করে। আমরা সব কিছু দেখি কিন্তু তারপরও কিছু বলতে পারি না। কারণ, তাদের হাত অনেক লম্বা। দালাল নির্মূলে বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। কদিন গেলেই আবার শুরু এদের উৎপাত। এই দালালদের সাথে আমাদের এই হাসপাতালের কর্মচারীদের অনেকেই জড়িত। তারা কমিশন পায়, তাই সব দেখেও চুপচাপ থাকে।’
নাম গোপন রাখার শর্তে এক দালাল বলেন, ‘সদর হাসপাতালে ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলেও অধিকাংশ সময় সেই পরীক্ষাগুলি হাসপাতালে হয় না। পাশাপাশি গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের মূলত আমরা টার্গেট করি। সদর হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকরা এলাকার স্থানীয় ও প্রভাবশালী। তাছাড়া হাসপাতালে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের মদদে মূলত দালালরা চলে। সবাইকে নিয়ে হাসপাতলকে ঘিরে এক একটি চক্র কাজ করে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দেওয়ার পর দালালরা রোগীদের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। একজন রোগী নিয়ে আসতে পারলে দালাল ১০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং পরিস্থিতি ভেদে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন পায়। যত বেশি পরীক্ষা করবে রোগী, তত বেশি কমিশন পাবে দালাল।’
নরসিংদী সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মাহমুদুল কবীর বাশার কমল বলেন, ‘দালাল নির্মূলে আমরা দফায় দফায় কার্যক্রম চালাচ্ছি। হাসপাতালে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সব সময় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যতই দালালদের দমাতে চেষ্টা করি, কোনো না কোনো দিক থেকে তারা আবার বেরিয়ে আসে। আমিও চাই, নরসিংদীর সদর হাসপাতাল সত্যিকারভাবেই দালালমুক্ত হোক, সেই জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2024, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available