কক্সবাজারে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করছেন এনসিপি নেতারা
কক্সবাজার প্রতিনিধি: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে হঠাৎ করেই কক্সবাজারের ইনানীতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাঁচ শীর্ষ নেতার রহস্যজনক সফরে আসেন। এনিয়ে রয়েছে মানুষের মাঝে আলোচনা-সমালোচনা। নেতারা কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই কেন আগমন করেছেন, তাদের বিলাসবহুল রিসোর্টে ওঠা, পরদিন আকস্মিক হোটেল পরিবর্তন- এসব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনার শুরু হয়েছে ।৬ আগস্ট বুধবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ রিসোর্ট ত্যাগ করেন এনপিপির এই শীর্ষ নেতারা। কলাতলী পৌঁছে শালিক রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজ করে বিকাল ৩টার দিকে উঠেছেন কক্সবাজার শহরের নামি-দামি হোটেল ‘প্রাসাদ প্যারাডাইসে’। ওখানে থাকেন রাত ১১টা পর্যন্ত। হঠাৎ এই স্থান পরিবর্তনও নজর এড়ায়নি স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের।পরিস্থিতির নানা পর্যায়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও গত দুই দিন ধরে তাদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখছেন বলে জানা গেছে।শুধু নজরদারিই নয়, গোপন বৈঠকের গুজব, বিদেশি কূটনীতিকের নাম ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা তথ্য, আর এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ- সব মিলে তাদের সফরটিকে ঘিরে তৈরি হয়ে রহস্যময়তা।৫ আগস্ট মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৪৩৩ ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছান এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা এবং যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ।বিমান থেকে নামার পর তারা কোনো ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার না করে সাধারণ যাত্রীদের গেট দিয়ে বের হন। সরাসরি চলে যান ইনানীর বিলাসবহুল সী পার্ল রিসোর্টে (রয়েল টিউলিপ)। সেখানেই শুরু হয় প্রথম ধাপের গুঞ্জন।এদিকে এনসিপি নেতাদের কক্সবাজার সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা জল্পনা চলছিল। বিশেষ করে বিদেশি কূটনীতিক, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে সম্ভাব্য গোপন বৈঠকের গুজব আরও উস্কে দেয় পরিস্থিতিকে।এ গুজবের পরপরই একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর হয়ে ওঠে। রয়েল টিউলিপ হোটেলের ভেতরে ও বাইরে সাদা পোশাকে অবস্থান নেন গোয়েন্দা সদস্যরা। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যন্ত সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখা হয় সেখানে কোনো বিদেশি নাগরিক প্রবেশ বা বৈঠকের চেষ্টা করেছিলেন কিনা।রয়েল টিউলিপের সিকিউরিটি প্রধান, সাবেক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের হোটেলে এনসিপি নেতাদের সঙ্গে কোনো বিদেশির বৈঠক হয়নি। এমনকি হোটেলে কোনো বিদেশিও ছিলেন না। কেউ বাইরে থেকে এসে বৈঠকও করেননি।তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে এনসিপি নেতারা আমাদের হোটেলে (রয়েল টিউলিপ) ওঠার পর থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হোটেলে এসে যাচাই করেছেন। গোয়েন্দারা হোটেলের সব ধরনের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েছেন এবং সেগুলো পর্যালোচনা করেছেন। বুধবার দুপুর ১টার পরপর এনসিপি নেতারা হোটেল ছেড়ে গেছেন।এদিকে এনসিপির পাঁচ শীর্ষ নেতার হঠাৎ এই সফর ঘিরে শুধু গোয়েন্দা সংস্থাই নয়, তাদের নিজ দলও অস্বস্তিতে পড়ে। সফরের কারণ না জানিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ দিনে কক্সবাজারে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সরাসরি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়।দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়—‘গত ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে আপনারা ব্যক্তিগত সফরে কক্সবাজারে গেছেন, অথচ এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্ষদকে কোনো তথ্য বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।’কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার আমি টেকনাফে ছিলাম। এর মধ্যে এনসিপির কয়েকজন নেতা কক্সবাজারের একটি হোটেলে এসেছেন বলে শুনেছি। নানা ধরনের কথাও শুনেছি, কিন্তু এসবের সত্য-মিথ্যা জানি না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করাও সমীচীন হবে না।এনসিপির নেতারা জেলা পুলিশের কাছে কোনো প্রটোকল চাননি। তবু তাদের গতিবিধি ঘিরে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দিন বলেন, এনসিপি নেতারা এখন শহরের প্রাসাদ প্যারাডাইস হোটেলে অবস্থান করছেন। তাদের নিরাপত্তা বিবেচনায় হোটেল ঘিরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।সফরের দুই দিন পার হলেও এখনো পরিষ্কার হয়নি এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত কোনো গোপন বৈঠকের প্রমাণ মেলেনি, তবে নজরদারি অব্যাহত আছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক মহল বলছে, বিদেশি যোগাযোগের গুজব পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।কক্সবাজারের পর্যটন নগরীতে হঠাৎ এ ধরনের সফর এবং তা ঘিরে ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতা এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। সব চোখ এখন প্রাসাদ প্যারাডাইস হোটেলের দিকে—এবার এই নেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, সেটিই দেখার বিষয়।