• ঢাকা
  • |
  • শুক্রবার ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বিকাল ০৫:৫৭:৪০ (17-May-2024)
  • - ৩৩° সে:
এশিয়ান রেডিও
  • ঢাকা
  • |
  • শুক্রবার ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বিকাল ০৫:৫৭:৪০ (17-May-2024)
  • - ৩৩° সে:

ফরিদপুরে বিলাসবহুল টেপাখোলা রিসোর্ট তৈরিতে ৩১টি গাছের মৃত্যু পরোয়ানা জারি

স্টাফ রিপোর্টার, ফরিদপুর: ফরিদপুরের সোহরাওয়ার্দী সরোবর তথা টেপাখোলা লেকপাড়ে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট' নামে ব্যয়বহুল এক বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের জায়গায় প্রকলপ বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। আর এ রিসোর্ট তৈরি করতে কেটে ফেলা হবে সেখানকার দীর্ঘদিনের পুরনো ৩১টি গাছ।ইতোমধ্যে গাছগুলো কেটে ফেলার টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে সেগুলোর গায়ে খোদাই করে চিহ্ন দিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ নিয়ে শহরবাসীর মাঝে উঠেছ নানা গুঞ্জন।বড় বাজেটের আয়েশী এ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত সরকারের গলায় শ্বেতহস্তীর মতো আটকে পূর্ণাঙ্গ রূপ না পেলে লেকপাড়ের বর্তমানের নিসর্গ পরিবেশটুকুও হারাতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে।২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একনেক বৈঠকে ২১১ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট' নামে এই প্রকল্পটি পাশ করা হয়। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একান্ত প্রচেষ্টায় মূলত এ প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে যায়। নকশা অনুযায়ী এই টেপাখোলা রিসোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, টেপাখোলা রিসোর্ট স্কুল ব্লক, জিমনেসিয়াম, মসজিদ, রিসোর্ট সেন্টার, ভিকটোরি মিউজিয়াম, ভিকটোরি কমপ্লেক্স, ওয়ান্ডার হুইল, ফুড কোড, সিনিয়র সিটিজেন কর্নার, আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট সেন্টার, চিল্ড্রেন ওয়াটার গেইম, চিল্ড্রেন সুইমিংপুল, টেপা ক্যাফে ও হল, অ্যাম্পিথিয়েটার, বোর্ট ল্যান্ডিং ক্যাফে ও বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ার তৈরির কথা। তবে পরে বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ারটি বাদ দিয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ ১৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে আজাদ আগামী একমাসের মধ্যে এই রিসোর্টের কাজ উদ্বোধন করবেন বলে এলজিইডি ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহিদুজ্জামান খান জানিয়েছেন।ফরিদপুর জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, টেপাখোলা লেকটি ১৪ একর জমির উপর অবস্থিত। এ লেকসহ আশেপাশে সবমিলিয়ে ১৮ একর জমির উপর লেকের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের প্রকল্প নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০২৬ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন প্রকল্প পরিচালক। আর একাজে প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সেখানকার দীর্ঘদিনের পুরনো ৩১টি গাছ বিক্রির জন্য গত ২৮ মার্চ ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিলাম করা হয়েছে।সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, টেপাখোলা লেকের পূর্ব পাড়ে এবং দক্ষিণ পাড়ের সড়কের পাশে অবস্থিত গাছগুলোর বেশিরভাগই মেহগনি গাছ। এর পাশাপাশি, আম, কাঁঠাল, নারকেল গাছও রয়েছে। গাছগুলির বয়স আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ বছর। এরই মধ্যে সেগুলোর শক্ত বাকল কেটে লাল রঙ দিয়ে সংখ্যা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোন সময় সেগুলো কেটে ফেলার কাজ শুরু হবে। এছাড়া গত মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে লেকের পানি তুলে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।তবে এ গাছগুলি কাটার সিদ্ধান্তে স্থানীয় বাসিন্দাসহ শহরবাসীর মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নগরায়নের যুগে শহরবাসীর প্রাতভ্রমণ, বৈকালিক হাঁটা এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি বড় স্থান এই লেকপাড়। বর্তমানে প্রচন্ড দাবদাহে প্রতিদিন বিকেলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সেখানে ছুটে যান অনেকেই। শুধু এই গরমে নয়, সারাবছরই শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে সর্বস্তরের লোকজন ছুটে আসেন এই লেকপাড়ে অলস ও অবসর সময় কাটাতে।ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদুর রহমান জানান, শৈশব থেকেই এই গাছগুলি দেখে আসছি। এখানকার লেকের স্বচ্ছতার সাথে গাছগুলোর ছায়াময় পরিবেশ এক দারুণ নিসর্গের অনুভূতি তৈরি করেছে। একারণে প্রাকৃতিকভাবেই এটি একটি সুন্দর বিনোদন স্পট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই গাছগুলো কেটে ফেললে এই পরিবেশটাই বদলে যাবে।আব্দুল আজিজ নামে এক যুবক জানান, এই গাছগুলোর ছায়ায় আমাদের শৈশব কেটেছে। প্রচন্ড গরমে শুধু আমরা নয়, শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একটু স্বস্তির আশায় ছুটে আসেন এখানে। এখন শুনছি এখানে বড় প্রকল্প হবে, বড় বড় ভবন হবে। এজন্য গাছগুলি কেটে ফেলা হবে। এ খবর শোনার পরে মনে স্বস্তি পাচ্ছি না।টেপাখোলা লেকপাড়ের বাসিন্দা এস এম মনিরুজ্জামান মনির নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী জানান, তীব্র গরমে শহরের মানুষ এসব গাছের তলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে থাকে। আমার জানামতে, লেকের উন্নয়নে যে নকশা ও ব্যয় বরাদ্দ হওয়ার কথা ছিলো তা সংকুচিত করা হয়েছে। আর যেহেতু মূল নকশা অনুযায়ী আর কাজটি হচ্ছে না তাই গাছগুলো রেখেই নতুন করে নকশা করা উচিত। আমরা চাই পরিবেশ রক্ষায় গাছগুলো রক্ষা করা হোক।সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাগর আহমেদ জানান, গাছগুলো আমাদের ফরিদপুর শহরের বহু স্মৃতিবিজড়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আগে এগুলো লাগানো হয়েছে। এখন এসব গাছ কেটে ফেলে, পুনরায় কোনো গাছ লাগিয়ে এ অবস্থায় আনতে আবার আমাদের অর্ধশতাব্দীকাল অপেক্ষা করতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী যেখানে এসব ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত করছেন, সেখানে এই গাছগুলো কেটে ফেলার পরে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও আমরা শংকিত। তখন এর দায়ভার নেবে কে? যাই করা হোক না কেন এ গাছগুলি রক্ষা করে করতে হবে।একই এলাকার বাসিন্দা ইফফাত আরা (২৬) জানান, এই গাছগুলো ফরিদপুরের অক্সিজেনের ভান্ডার। এলাকার সকল স্তরের মানুষ এ গাছতলায় এসে বিশ্রাম নেন, প্রাণ জুড়ান। আমাদের সকলের উদ্যোগে গাছ কাটার এ পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে।টেপাখোলা লেকের পূর্বপাশে অবস্থিত ফরিদাবাদ এলাকার বাসিন্দা আরিফুর রহমান (৩৯) জানান, উন্নয়ন হোক তা আমরাও চাই। কিন্তু এজন্য গাছ কাটতে হবে কেন। পূর্বদিকে গাছগুলি লেক পাশের রাস্তার পূর্বদিকে আছে এবং দক্ষিণ পাশের গাছগুলি রাস্তা উত্তরে লেকের পাড়ে আছে। এ লেকের সৌন্দর্য বাড়াতে গাছ কাটতে হবে কেন।ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য মনোয়ারুল ইসলাম জানান, গাছগুলি রাস্তার পাশে এবং লেকের পাড়ে অবস্থিত। আমি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। তবে আমার মনে হয়েছে, গাছগুলি রক্ষা করে এ প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব। গাছগুলি কেটে ফেলার উদ্যোগের কোনো যুক্তিসংগত কারণ দেখছি না।ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল আলম মিলন জানান, কোনো যুক্তিতেই ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী এ গাছগুলি কেটে ফেলা আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। গাছগুলি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। বড় বড় এ গাছগুলি কেটে ফেললে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এ উদ্যোগ আমরা নাগরিক সমাজ মেনে নিতে পারি না।ফরিদপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বাকাহীদ হোসেন জানান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন ও বড় বড় ওই গাছগুলি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এগুলি রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আমাদের জানানো হয়। তিনি বলেন, ওই ৩১টি গাছ কাটা হলেও পাশাপাশি এক হাজার ৭৬২টি গাছ রোপণ করা হবে। এটি সরকারি উদ্যোগে একটি দৃষ্টি নন্দন কাজ হবে। এ কাজের স্বার্থে আপাতত এ ক্ষতি আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।