• ঢাকা
  • |
  • সোমবার ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩২ রাত ০৯:২৭:০৯ (08-Dec-2025)
  • - ৩৩° সে:

মণিরামপুরের গর্ব শহীদ আকরাম

স্বাধীনতার স্বপ্নে জীবন উৎসর্গ করা এক নিভৃত নায়ক

৮ ডিসেম্বর ২০২৫ রাত ০৮:২৬:০৩

সংবাদ ছবি

মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি: যশোরের মণিরামপুর উপজেলায় শেখ আকরাম হোসেন নামটি এলাকায় উচ্চারণ হলেই স্মরণ করা হয় এক মমত্ববোধের, এক সাহসিকতার, আর এক অসমাপ্ত স্বপ্নের গল্প। মাত্র ২৭ বছরের এক তরুণ শেখপাড়া খানপুর গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে শেখ আকরাম হোসেন। এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও বুকভরা দেশপ্রেমে ছিলেন অসাধারণ। তিনি উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামে ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে মণিরামপুর পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং পরবর্তীতে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি চুয়াডাঙ্গা দত্তনগর কৃষি ফার্মে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানিরা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে নির্বিচারে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি চাকরিরত অবস্থায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য হাজারো প্রতিবাদী তরুণের মতো যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে এবং চাকরি ছেড়ে এলাকায় চলে আসেন।

Ad

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রথম থেকে মণিরামপুর, ঝিকরগাছার বাঁকড়া, শার্শা, কলারোয়া এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখেন। কিন্তু সেই উত্তাল সময়ে রাজাকারদের চোখ এড়ানো ছিল কঠিন। স্থানীয় দালালরা তালিকা তৈরি করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। উপজেলার পাতনের ইয়াকুব কবিরাজের ছেলে কুখ্যাত রাজাকার মেহেরুল ইসলামও ছিল তাদের একজন। আকরামের মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের এই খবর জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মেহেরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধে আকরামের যোগদান তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করেছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে আকরামকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর প্রথমে স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে তার উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। তাকে ৭ দিন স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রেখে মুক্তিবাহিনীর তথ্য উদঘাটনের জন্য অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তিবাহিনীর তথ্য আদায়ের নামে প্রতিদিন নতুনভাবে তাকে অত্যাচার করা হতো; কিন্তু অদম্য সাহসী আকরাম কখনো মুখ খোলেননি একবারও নয়।

Ad
Ad

আকরাম রাজাকারদের কোনো তথ্য না দেওয়ায় তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যায় পরবর্তীতে তাকে তাহেরপুর থেকে জুড়োনপুর রাস্তার মোড়ে ধরে নিয়ে আসে। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চলে, কিন্তু তারপরও তিনি মুখ খুলেননি। এরপর শুরু হয় রাজাকার মেহেরুলের প্রকাশ্য বর্বরতা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে শরীর রক্তাক্ত করে ক্ষতস্থানে লবণ-লঙ্কা মাখিয়ে যন্ত্রণাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আকরাম যন্ত্রণায় কাতর হলে পাশের রাজাকাররা তেতে উঠত আরও বেশি, উল্লাস করত তার প্রতিটি চিৎকারে। পানি চাইলে তাকে পানি দেয়া হয়নি; বরং রাজাকার মেহেরুল তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতনে আকরাম অচেতন হয়ে পড়লে তাকে আবার টেনে তুলে ফিরিয়ে আনা হতো জ্ঞান, যেন নতুন করে শুরু করা যায় সেই ভয়াবহ নির্মমতা। এভাবে চালানো নির্যাতনে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন। তার ওপর এমন নৃশংসতা চালানোর কারণে পরে এলাকার মানুষ মেহেরুলকে ডাকতে শুরু করে মেহের জল্লাদ নামে। এরপর থেকেই মণিরামপুরের মানুষের কাছে শেখ আকরাম হোসেনের নাম হয়ে ওঠে এক প্রতিরোধের প্রতীক, সত্যিকারের বীরত্বের প্রতিচ্ছবি।

আলতাফ হোসেনের আট ছেলের মধ্যে আকরাম ছিলেন একমাত্র পুত্রসন্তান। তাঁর মা জোছনা খাতুন বারবার রাজাকারদের সামনে এসে ছেলের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন, আকুতি মিনতি করেছিলেন; কিন্তু বর্বরদের মন গলেনি। যখন পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছায়, তখন তিনি শোকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং পুত্রশোকে ধুঁকতে-ধুঁকতে এক পর্যায়ে তিনিও মারা যান। আকরামের লাশও পায়নি তার পরিবার তবে এলাকাবাসীর গর্ব ছিল, এই মাটিই জন্ম দিয়েছিল এমন এক বীর সন্তানকে, যে জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে মুক্তিযুদ্ধের গোপন তথ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাহেরপুর মোড়ের সেই নির্মম হত্যাস্থলটির নামকরণ করা হয় শহীদ আকরাম মোড় যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে এই মাটির আর্তচিৎকার আর রক্তস্নাত ইতিহাস।পরবর্তীতে মণিরামপুর উপজেলার প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম লুৎফর রহমান শহীদ আকরাম হোসেনের নামে মণিরামপুর থেকে রাজগঞ্জ সড়কের নামকরণ করেন।

বছরের পর বছর মানুষ মুখে মুখে বলেছে আকরামের গল্প; তার সাহস, তার নীরব প্রতিরোধ, আর তার যন্ত্রণায় মৃত্যুবরণ করার অকল্পনীয় ইতিহাস। কিন্তু তার স্মৃতিতে কোনো স্থায়ী স্মারক ছিল না। অবশেষে ২০১৩ সালে তাহেরপুরবাসী, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড এবং তরুণ সমাজের উদ্যোগে শেখ আকরাম হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞলি ফলক স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ২০২২ সালে হাজ্বী মো. নূর আলী মোড়লের দানকৃত জমিতে টি আর কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ আকরাম স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপিত করা হয়। যা এখন এ অঞ্চলের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিন সেখানে আসে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা, প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী। কেউ ফুল দিয়ে, কেউ নীরবে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায় এই দেশের এক নিভৃত বীরের প্রতি। মণিরামপুরের ঐতিহ্য নিয়ে বছরের পর বছর প্রবীণরা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প, আর তরুণেরা শিখছে এক সত্যিকারের বীরের আত্মত্যাগের ইতিহাস।

স্থানীয়রা বলেন, এতদিন ধরে শুধু মুখে মুখে আকরামের গল্প বেঁচে ছিল, এখন তার স্মৃতি স্তম্ভ সেই গল্পকে চিরস্থায়ী করে দিয়েছে। জাতীয় দিবসগুলোতে এলাকাবাসী সেখানে সমবেত হয়ে শহীদ শেখ আকরামের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, এই স্তম্ভটি শুধু আকরামকে স্মরণ করার জন্য নয়, এটি প্রমাণ করে দেশপ্রেমিক কেউ কখনো হারিয়ে যায় না। ইতিহাস তাকে ফিরিয়ে আনে। শহীদ শেখ আকরাম স্মৃতি স্তম্ভ এখন তাহেরপুরের পরিচয়েরই অংশ। মোড়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে যায় কাদা, বাঁশঝাড় আর সেই শোকাবহ দিনের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের দৃশ্য। আজও বাতাস যেন বলে ওঠে, এ দেশ স্বাধীন হয়েছে বীর আকরামের মতো তরুণদের আত্মত্যাগে।

Recent comments

Latest Comments section by users

No comment available

সর্বশেষ সংবাদ






সংবাদ ছবি
বাউল শিল্পী আবুল সরকারের জামিন নামঞ্জুর
৮ ডিসেম্বর ২০২৫ রাত ০৮:২২:২৩






Follow Us