এম এফ ইসলাম মিলন: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি ঘটনার নাম নয়- এটি মানুষের স্বাধীন চিন্তা, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্রের প্রতি জবাবদিহিতার নতুন আশা। এই স্পিরিটকে ধারণ করা প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তির সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: এগোতে হবে কোন পথে? ঠিক এই জায়গাতেই এনসিপি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

১. জুলাই সনদ ও জনগণের স্পষ্ট ইচ্ছা: জুলাই সনদ নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থান মোটামুটি পরিষ্কার- এটি বাস্তবায়নের পক্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ দৃঢ় মত প্রকাশ করে যাচ্ছে। একটি প্রশ্নই এই সনদের মূলে- আপনি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান? হ্যাঁ অথবা না। এই প্রশ্নে একটি গণভোট হলে জনগণের রায় সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসবে এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতকেও কাঠামোবদ্ধ করবে। অনেকে মনে করেন- এই গণভোট নির্বাচনের আগেই হওয়া উচিত, যাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া জনগণের স্পষ্ট মতের ভিত্তিতে সাজানো যায়।


২. জোট রাজনীতি: এনসিপির জন্য ঝুঁকি কোথায়? বর্তমান পরিস্থিতিতে জোট রাজনীতি এনসিপির জন্য যেমন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি বড় ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে। কেন ঝুঁকি? জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সব দলের অবস্থান এক নয়। বিশেষ করে কিছু দল- ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করাকে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দেখে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক তৈরি, বিশেষত ভারতের সঙ্গে সমঝোতা- এগুলো বড় দলগুলোর রাজনৈতিক কৌশলে কখনো কখনো প্রধান ভূমিকা নেয়। এ অবস্থায় এনসিপি যদি অন্ধভাবে জোটে যায়, তাহলে নিজস্ব অবস্থান, সনদ ও জনগণের ভরসা- সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এনসিপিকে তাই যেকোনো জোটের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- ‘১০ বার ভেবে’, নিজেদের নীতিগত অবস্থান ও জনগণের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে।
৩. বিএনপির সঙ্গে সম্ভাব্য জোট- সুযোগ না ফাঁদ? বিএনপি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি- এটি সত্য। তবে বিভিন্ন বিশ্লেষক মনে করেন: বিএনপি মূলত ক্ষমতায় ফেরার সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দেয়। বড় পরিসরের নির্বাচনে তারা নিজেরাই সব জায়গায় প্রার্থী দিতে চায়। জোটে গেলেও, বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়ানোর ঝুঁকি থাকে, যা ছোট দলের ভোট- ব্যাংককে তছনছ করতে পারে। ফলে এনসিপির কপালে ‘জোটের ভোট’ পাওয়া হতে পারে সোনার হরিণের মতো কঠিন। এ কারণেই অনেকেই মনে করেন- এনসিপিকে অন্ধ জোটের রাজনীতিতে জড়ানোর আগে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
৪. এনসিপির স্বাধীন নেতৃত্বের প্রয়োজন: জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট যেখানে স্বাধীনতা, সাহসিকতা এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রতীক, সেখানে এনসিপিকে সেই স্পিরিটের রক্ষক হিসেবে দাঁড়াতে হবে। এখন করণীয়- জনগণের রায়কে সামনে আনা: জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে সরাসরি জনগণকে যুক্ত করা- এটি এনসিপির জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পারে। নিজস্ব নেতৃত্বকে সামনে আনা: জোট রাজনীতির ভরসায় না থেকে এনসিপিকে নিজের নেতৃত্ব, নিজস্ব প্রার্থী ও নিজস্ব অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করা: কোন দলের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা সম্ভব এবং কোনটি জনগণের স্বার্থের বিরোধী- এটা স্পষ্ট করে বলা জরুরি।
৫. জামায়াত ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা: রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো ও ভোট- নিষ্ঠা একটি নির্দিষ্ট দলের জন্য ‘নিরাপদ রাজনৈতিক মাঠ’ তৈরি করে। তবে এটি রাজনৈতিক মত বিশ্লেষণ, কোনো দলীয় সত্য নয়। তবে জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট জামায়াতের মধ্যে দৃশ্যমান, যা তুলনামূলকভাবে অন্য দলে দেখা যায় না। সেই দিক থেকে বিচার করলে জামায়াত-এনসিপি অনেকটাই কাছাকাছি। সেই হিসাবে, এনসিপিকে যেকোনো সম্পর্ক বা সমঝোতা করতে হলে- জনগণের প্রতিক্রিয়া, জাতীয় স্বার্থ ও জুলাই সনদের নীতিমালা- এই তিনটি বিষয়ই মাপকাঠি হওয়া উচিত। এনসিপির সামনে সুযোগ- জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আগে গণভোট, তারপর নির্বাচন। এনসিপির দাবি শক্তিশালী হলে নির্বাচনের আগেই গণভোট হবে, হতে বাধ্য। তবে, এই সুযোগ হারালে ক্ষতি অপরিমেয়।
আজকের সময়ে সবচেয়ে বড় সত্য- জুলাই আন্দোলনের পর জনগণ নতুন রাজনীতি চায়। এই আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারে এমন দল যদি নিজের অবস্থান দুর্বল করে ফেলে, তাহলে তারা অন্ধকারে তলিয়ে যাবে- রাজনৈতিক বাস্তবতা এটিই বলে। এনসিপিকে তাই- নিজের অবস্থানে অবিচল থাকতে হবে, জনগণের রায়কে সম্মান দিতে হবে, জুলাই সনদকে রাজনৈতিক চুক্তির কেন্দ্রে আনতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে জোট রাজনীতিতে প্রবেশের আগে ভারতবিরোধী শক্তিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ভারত ও তাদের আশীর্বাদপুষ্টরাই আগামীতে এনসিপির মরণফাঁদ হবে।
একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে-এনসিপি সামনে এগোবে, নাকি অন্ধকারে আটকে যাবে।
লেখক: ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available