• ঢাকা
  • |
  • মঙ্গলবার ১৩ই কার্তিক ১৪৩২ দুপুর ১২:৫২:০৮ (28-Oct-2025)
  • - ৩৩° সে:

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ

২৮ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ০৯:৩২:১১

সংবাদ ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ ২৮ অক্টোবর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান এর ৫৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। এই দিনে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সেই অকুতোভয় বীর'কে, যিনি জীবন উৎসর্গ করে রচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার খোর্দ খালিশপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ৭ ভাইবোনের মধ্যে হামিদুর ছিলেন সবার বড়ো। পারিবারিক আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় বড়ো ভাই হিসেবে ছোটোবেলা থেকেই হামিদুরকে পারিবারিক কিছু বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হতো। কিশোর হামিদুর ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। গ্রামে খেলাধুলায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। তবে অভাব-অনটনের মধ্যে কৈশোর না পেরুতেই পিতার ইচ্ছানুযায়ী হামিদুর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মুজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হন। এরই মধ্যে একদিন যশোরের চৌগাছায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মহড়া দেখে তাঁর মনে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগ্রহ জন্মে। সেই আগ্রহ থেকেই ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে যশোর এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং টিম আসলে হামিদুর সৈনিক হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান। রিক্রুটিং টিম সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হামিদুরকে সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করে।

Ad
Ad

১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রশিক্ষণের জন্য হামিদুর চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে যোগদান করেন। রিক্রুটদের এই প্রশিক্ষণ ৬ মাস হওয়ার কথা থাকলেও দেশের চলমান পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ শুরুর কিছুদিন পরই হামিদুরের জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ইবিআরসির রিক্রুটদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। এই গোলাগুলির মাঝে হামিদুরসহ কিছু সংখ্যক রিক্রুট ইবিআরসির পশ্চিম দিকের পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরে সুযোগ বুঝে ইবিআরসি থেকে বের হয়ে প্রথমে নিজ বাড়ি ও পরে যশোরের চৌগাছায় অবস্থানরত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রবল আগ্রহের কথা জানান। সেই থেকে হামিদুরকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নিয়মিত সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁর সৈনিক নম্বর দেওয়া হয় ৩৯৪৩০১৪। পরবর্তীতে তাঁর অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও কর্মোদ্যম দেখে সে সময় তাঁকে কোম্পানি কমান্ডারের রানার নিয়োগ করা হয়। যুদ্ধে একজন কমান্ডারের রানারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা কমান্ডারের যে-কোনো আদেশ-নিষেধ সঠিকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকে।

Ad

সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের শেষ যুদ্ধ ছিল ঐতিহাসিক ধলই যুদ্ধ। সিলেট জেলার (পরবর্তীতে মৌলভীবাজার জেলা) শ্রীমঙ্গল থানার আনুমানিক ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ধলই অবস্থিত। সীমান্তের প্রায় ৪০০ গজ দূরে ধলই চা-বাগানের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ধলই বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি)। ধলই বিওপি দখলের জন্য ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'সি' কোম্পানিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেই কোম্পানিরই একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমান।

এদিকে ধলই এলাকার গুরুত্ব বুঝতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ৩০ এফএফ এবং এক কোম্পানি রাজাকার ধলই বিওপিতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ধলই বিওপিতে শত্রুর অবস্থান এতই সুদৃঢ় ছিল যে, সেখানে অটোমেটিক অস্ত্রগুলো কংক্রিটের বাংকারে ছিল, যা মাঝারি আর্টিলারি গোলা বর্ষণও প্রতিরোধ করতে সক্ষম ছিল। বিওপির সম্মুখে শত্রু সেনারা পাঞ্জি (মাটিতে পুঁতে রাখা ধারালো অস্ত্র) এবং মাইনও পুঁতে রেখেছিল। এই অবস্থানকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ধলই ভ্যালী ক্লাবে একটি আর্টিলারি ব্যাটারিও মোতায়েন ছিল।

২৮ অক্টোবর ভোররাতে মূল আক্রমণ শুর হয়। মূল দল ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের নেতৃত্বে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যায়। আর্টিলারি ফায়ারের আড়ালে ৭ নং প্ল্যাটুন ডানে ও ৯ নং প্ল্যাটুন বামে যথাক্রমে নায়েব সুবেদার আবুল হাশেম এবং সুবেদার সাত্তারের নেতৃত্বে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক সময় সব বাধা অতিক্রম করে তাঁরা শত্রু অবস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও যায়। পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে ফলে, 'সি' কোম্পানি প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এদিকে ফোর্স হেডকোয়ার্টার থেকে বেতারে বার্তা পাঠানো হয় যে, যে-কোনো মূল্যেই হোক ধলই দখল করতেই হবে। ফলে অদম্য প্রেরণা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ আবারও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর একটি এলএমজির অবিরাম গুলি বর্ষণে অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কাইয়ুম যেকোনো মূল্যে সিপাহি হামিদুর রহমানকে এই এলএমজি থামানোর নির্দেশ দেন। অধিনায়কের নির্দেশ পেয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্ভীকযোদ্ধা সিপাহি হামিদুর রহমান ক্রলিং করে এগিয়ে যান এলএমজির দিকে। বিওপির পাশ দিয়ে একটি কাঁচা রাস্তা ভারতের দিকে প্রবাহিত তারই পাশ দিয়ে একটি চা-বাগানের সেচের খালের ভেতর দিয়ে এলএমজি পোস্টের একেবারে নিকটে চলে যান।

এ সময় শত্রু তাঁকে দেখে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে হামিদুর বীরবিক্রমে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৭ নম্বর প্ল্যাটুনের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা অনুযায়ী সে সময় সিপাহি হামিদুর রহমান দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে তিনি শত্রু সৈন্যদ্বয়কে ঘায়েল করেন এবং নিজেও গুরুতর আহত হন। তারপরও তিনি শত্রুর এলএমজি বাংকারে গ্রেনেড ছুড়ে শত্রুর এলএমজি ম্যানকে নিষ্ক্রিয় করেন। এরপর মুক্তিসেনারা ঝড়ের গতিতে ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে প্রবেশ করেন। এলএমজি পোস্টের পাশে সিপাহী হামিদুর রহমানের মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়, তাঁর পাশেই ছিল দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের মৃতদেহ। তাঁর বীরত্বের ফলস্বরূপ ১ ইস্ট বেঙ্গল ধলই বাগানের কিছু অংশ এবং পত্রখোলা চা-বাগানের কিছু অংশ দখল করে নেয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তাঁর কোম্পানি নিয়ে একটু সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ধলই যুদ্ধ ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। একটানা দীর্ঘ ৭দিন যুদ্ধের পর অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা ধলই বিওপি দখল করতে সক্ষম হয়।

ধলই বিওপি দখলে শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানের কৃতিত্ব ও অবদান অবিস্মরণীয়। নিজের জীবন বিপন্ন ও শেষ পর্যন্ত উৎসর্গ করে তিনি সহযোদ্ধাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। সেদিন সহযোদ্ধারা এই বীর শহীদের মরদেহ বয়ে নিয়ে ভারতের আম্বাসা গ্রামে দাফন করেছিল। দীর্ঘদিন পর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গত ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারত থেকে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে এনে পুনরায় দাফন করা হয়।

দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধের অনন্যসাধারণ যে উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন তা নিঃসন্দেহে তাঁকে একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে অনন্য করে তুলেছে। সিপাহী হামিদুর রহমান নামটি তাই সকলের মনে চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

Recent comments

Latest Comments section by users

No comment available

সর্বশেষ সংবাদ




সংবাদ ছবি
শ্রীবরদীতে হাতির তাণ্ডব, উদাসীন বন বিভাগ
২৮ অক্টোবর ২০২৫ দুপুর ১২:০৫:৪৬





সংবাদ ছবি
লরির ধাক্কায় উল্টে পড়ল ট্রেন, নিহত ১
২৮ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ১০:৩৫:২৩



Follow Us