নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা নগরীর অন্যতম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা টমটম। প্রতিদিনই রাজধানীর সড়কে এ যানবাহনের কারণে তীব্র যানজট ও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
অটোরিকশার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এখন নগর জীবনের জন্য এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন গতি, নিম্নমানের ব্রেকিং সিস্টেম এবং অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। বাড়ছে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব। নগরবাসীর কাছে তাই এই যান এখন প্রকৃত অর্থেই এক ‘গলার কাঁটা’।
ট্রাফিক পুলিশের তথ্য বলছে, ঢাকায় বৈধ অনুমোদনের চেয়ে বহু গুণ বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। অতিরিক্ত সংখ্যা ও বেপরোয়া গতি যানজট বাড়াচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। রাস্তাঘাটে এদের দখলদারি পথচারীদের জন্যও চরম ভোগান্তি তৈরি করেছে। শুধু দুর্ঘটনা নয়, এই যান ছিনতাইকারীদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা নগরীর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে রাজধানীর বুকে এই ত্রি-চক্র যান কার্যত ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকার ও ট্রাফিক বিভাগ এ সংকট সামাল দিতে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিল। রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পরীক্ষামূলকভাবে ‘ট্র্যাপার’ (ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণকারী সরঞ্জাম) বসানো হয়েছিল। মনে করা হচ্ছিল এটি রিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশাওয়ালারা এসবের তোয়াক্কা করে না।
পরিবেশ ও বিদ্যুৎ খাতেও এই যান বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোয় ব্যবহৃত নিম্নমানের লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতিটি যান ৪ থেকে ৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন এই খাতে নষ্ট হচ্ছে অন্তত ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অবৈধ সংযোগ থেকে চার্জ নেয়ার কারণে বাড়ছে লোডশেডিং, ভোগান্তিতে পড়ছেন বৈধ গ্রাহকরা। এসব যান তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানি ও উৎপাদন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিশ্চিত হয়।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা আরও উদ্বেগজনক। ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি যথাযথভাবে রিসাইক্লিং না করেই ফেলে দেওয়ায় মারাত্মক সীসা দূষণ ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, সীসা মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত সমন্বিত নীতি প্রণয়ন না করলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে। তাই অবিলম্বে এসব যান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, নইলে নগরবাসীর নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য এর মাশুল হবে ভয়াবহ।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই ব্যাটারি চালিত থ্রি-হুইলার। ঢাকার সড়কে চলাচলকারী ১৮ ধরনের যানবাহনের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি দেখিয়েছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা সবচেয়ে বিপজ্জনক যান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এই যানগুলোর নকশা দুর্বল, নিরাপত্তা মানদণ্ড নেই, ফলে সামান্য ধাক্কাতেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও আইনের আওতায় না আনার কারণে এ যান এখন শহরের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকারও বেশি আয় করে থাকেন। অর্থাৎ বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার সমপরিমাণ উপার্জন করেন তারা। অথচ তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় না ইনকাম ট্যাক্স, রোড ট্যাক্স কিংবা রেজিস্ট্রেশন ফি। যেখানে দেশের গড় মাসিক আয়ের সীমা ২০-২৫ হাজার টাকা, সেখানে এ যানচালকেরা গড় আয়ের চেয়ে বেশি আয় করছেন।
কিন্তু সামাজিক প্রচলিত ধারণা এখনো তাদের ‘গরিব’ বলে চিহ্নিত করে।
ঢাকা শহরবাসীর অভিযোগ, এসব যানবাহনের চালকেরা কোনো নিয়ম-নীতি মানেন না। উল্টোপথে গাড়ি চালানো, যত্রতত্র দাঁড়ানো, সিগন্যাল ভাঙা এবং লাইসেন্স ছাড়াই রাস্তায় নামা—এসব কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করছেন, কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছেন।
পরিবহন বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সমস্যা সমাধানের জন্য নগর ও মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত টমটম ও অটোরিকশার চলাচল সীমিত করা জরুরি। একইসঙ্গে দ্রুত রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স এবং নির্দিষ্ট রুটে চলাচলের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তা না হলে নগর জীবনের দৈনন্দিন ভোগান্তি ও সড়ক নিরাপত্তা সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available