মতলব উত্তর (চাঁদপুর) প্রতিনিধি: চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় গত এক বছরে ঘটে গেছে ১৪টি হত্যাকাণ্ড। এর বেশিরভাগই ঘটেছে পারিবারিক কলহ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের কারণে।
মতলব উত্তর থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত খুনের ঘটনায় পরিসংখ্যান দাঁড়িয়েছে, সম্পত্তি সংক্রান্ত হত্যা ৩টি, পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা ৩টি, পূর্ব শত্রুতা থেকে হত্যা ৩টি, পারিবারিক কলহে হত্যা ২টি, আধিপত্য বিস্তার সংক্রান্ত হত্যা ২টি, আকস্মিক আঘাতে হত্যা ১টি। এছাড়া গত ১ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১টি, আত্মহত্যার প্ররোচনায় ৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৮টি, ধর্ষণ আইনের ৪টি, অপমৃত্যুর ৪৬টি (এর মধ্যে ফাঁসি দিয়ে ১০টি, পানিতে ডুবে ১৪টি, বিষ পানে ৯টি, বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে ৬টি, সড়ক দুর্ঘটনায় ৫টি, গাছের আঘাতে ১টি, আগুনে পুড়ে ১টি) মামলা হয়েছে।
মতলব উত্তরে এক বছরের পরিসংখ্যান একটি উদ্বেগজনক সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরছে যেখানে নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, পরিবারের ভেতরের অশান্তি, জমি-সম্পত্তির দ্বন্দ্ব ও ছোটখাটো বিরোধ দ্রুত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজ দুই দিক থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ ধারা থামানো কঠিন হবে।
এই সময়ে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে গত ১৩ আগস্ট ২০২৫ উপজেলার এখলাছপুরে অটোরিকশা চালক মিজানুর রহমান অভিকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা। ১১ জুলাই সাদুল্ল্যাপুর ইউনিয়নে ঘটক হাবিব উল্লাহকে শ্বাসরোধ করে হত্যা। ৪-৫ জুলাই কলাকান্দা ইউনিয়নের ফরহাদ জুয়েলের মরদেহ মেঘনা নদীতে উদ্ধার, মাথা ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন। ৩০ জুলাই দুর্গাপুর ইউনিয়নে কিস্তি নিয়ে বিরোধে ভাতিজা মাইনুদ্দিন সরকারকে চাচার হাতে খুন। ৩০ জানুয়ারি মোহনপুর ইউনিয়নের মেঘনা নদী এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন বিরোধে গোলাগুলিতে রিফাত ও রাসেল নিহত। ৫ জানুয়ারি কালীরবাজার এলাকার ধনাগোদা নদী থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ি।
৫ নভেম্বর ২০২৪ সুলতানাবাদ ইউনিয়নে ধানের চারা নিয়ে বিরোধে কৃষক কবির সরকার নিহত। ৭ ডিসেম্বর সাদুল্ল্যাপুর ইউনিয়ন পুটিয়ারপার এলাকায় পানিনিষ্কাশনের নালা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর আংশিক পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪ অক্টোবর ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নে স্ত্রী ফেরদৌসী আক্তার আন্নাকে হত্যা করে নদীতে মরদেহ ফেলেন স্বামী ইয়াসিন। ১৬ অক্টোবর ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়ন লুধুয়া গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধে ছেলে নোমান বাবাকে ছুরি মেরে হত্যা করে। ২৮ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নের মিঠুরকান্দি গ্রামে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে আপন ভাই সফিকুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যা। ২১ সেপ্টেম্বর ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের দিঘলীপাড় গ্রামে ছেলের হাতে মা শেফালী বেগম খুন। ৩ সেপ্টেম্বর ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের মান্দারতলী গ্রামে পরিকল্পিতভাবে অটোরিকশা চালক খবির প্রধানকে হত্যা। ২৭ আগস্ট বাগানবাড়ি ইউনিয়নের খাগুরিয়া গ্রামে সীমানা বিরোধে সংঘর্ষে জহির নিহত হন।
এ বিষয়ে ছেংগারচর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনজির আহমেদ বলেন, একসময় গ্রামীণ শালিসি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের গভীর আস্থা ছিল। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা ও পক্ষপাতিত্বের কারণে এই আস্থা নষ্ট হয়েছে। ফলে ছোট বিরোধও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ রবিউল হক বলেন, এ হত্যাকাণ্ডগুলো অনেকটাই পারিবারিক কারণে ঘটেছে। তবে হত্যাকাণ্ড তো হত্যাকাণ্ডই। আমরা ইতোমধ্যে বেশিরভাগ আসামিকে আইনের আওতায় এনেছি। অপরাধী যেই হোক, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব বলেন, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার অভাব এবং ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতাই গ্রামীণ এলাকায় হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণ হয়ে উঠছে। এ ধরনের ঘটনা রোধে পরিবার ও সমাজ উভয়কেই সচেতন হতে হবে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available