পঞ্চগড় প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভ্যানচালক বাবা, অভাবের সংসার, চারপাশের কটু কথা- সবকিছুকে হারিয়ে দিয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামের ফেরদৌসি আক্তার সোনালী। তিনি এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক।
অনুর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের খেলা শেষে লাওস থেকে দেশে ফিরেই ওই ফুটবলার কন্যা ছুটেছেন জন্মভিটায়। দীর্ঘদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত বাবা ফারুক ইসলাম। গর্বের সুরে বলেন, ‘আমি ভ্যান চালাই, আমার মেয়ে বিমানে চড়ে দেশ-বিদেশে খেলতে যায়’।
সোনালী বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বনগ্রামে। বাবা ফারুক ইসলাম পেশায় একজন ভ্যানচালক। মা মেরিনা বেগম গৃহিণী। তিন সন্তানের মধ্যে সোনালী বড়। অভাবের সংসারে খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া ছিল দুঃসাধ্য, কিন্তু ফুটবলকে ভালোবেসে সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যান তিনি।
১৫ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে আসেন ওই ফুটবলার কন্যা।
জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের বাড়ি পর্যন্ত বাবার ভ্যানেই পৌঁছেন তিনি। সোনালী বাড়িতে পা রাখতেই জড়ো হতে থাকে স্থানীয়রা। মেয়ের সাফল্যে বাবা ফারুক ইসলাম মিষ্টি খাওয়ান সবাইকে।
ফারুক ইসলাম জানান, তার সম্পদ বলতে ভিটেবাড়ির কেবল ৭ শতক জমি আর উপার্জনের ব্যাটারি চালিত একটি ভ্যান। এ ভ্যান চালিয়ে সংসার চালালেও মেয়ের স্বপ্নের জন্য কখনো পিছপা হননি। অভাব-অনটনের সংসারে মেয়ের ফুটবল খেলা ছিল একসময় প্রতিবেশীদের কটাক্ষের কারণ। বাঁকা চোখে তাকাতো গ্রামের মানুষজনও, মেয়ের ফুটবল খেলা নিয়ে বলতো কটু কথা। তবে কোনো বাধাই সোনালীর মনোবল ভাঙতে পারেনি।
জানা গেছে, সোনালীর বয়স এখন ১৮ বছর। ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ শুরু হয় স্থানীয় গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন। সেখান থেকেই অংশ নেন বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। পরবর্তীতে ভর্তি হন হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, যেখানে স্কুলের হয়ে অংশ নেন আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে। তখনই পঞ্চগড়ের টুকু ফুটবল একাডেমিতে শুরু করেন প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন।
২০২৩ সালে তার ফুটবল প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ সুযোগ মেলে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হওয়ার। বর্তমানে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিকেএসপিতে গোলরক্ষক হিসেবে কঠোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
ফেরদৌসি আক্তার সোনালী বলেন, বিকেএসপিতে পড়াকালীন জাতীয় দলে সুযোগ মেলে। এরপর সিনিয়র টিমের সঙ্গে জর্ডানে খেলতে যাই। সেখানে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর সাফ অনুর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। সর্বশেষ এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে লাওসে খেলতে যাই। সেখানে রানার্সআপ হই।
বাবা ফারুক ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকেই সোনালীর ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল। অনেকেই নানান কথা বলতো, আমার মেয়ে এসবে পাত্তা দিতো না। অনেক সময় আমিও নিষেধ করতাম, তারপরও ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকতো।
তিনি আরও বলেন, টানাপোড়নের সংসারে তাকে সেভাবে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে পারিনি, খেয়ে না খেয়ে অনুশীলনে যেতো। আজকে আমার মেয়ে জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছে, দেশের হয়ে বিদেশে খেলছে- এটা আমার গর্ব।
সোনালীর মা মেরিনা বেগম বলেন, ফুটবল খেলে আমার মেয়ে অনেক পুরস্কার এনেছে। তার স্বপ্ন ছিল ফুটবলে ভালো কিছু করার। অনেক কষ্ট করে মেয়ে অনুশীলনে যেত। অনেক সময় টাকার অভাবে অনুশীলনে যেতে পারতো না। মাঝে মধ্যে আমরা নিষেধও করেছি, কিন্তু শোনেনি। এখন জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে, আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে দেশের ফুটবলকে ভালো কিছু উপহার দিবে। সোনালী অনুশীলন করতেন পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমিতে।
অ্যাকাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, সোনালী দারুণ সম্ভাবনাময়ী একজন মেয়ে। ফুটবলে সফলতা পেতে অনেক কষ্ট করেছে সে। আমি তাকে নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলাম, সে আমার আশা পূর্ণ করেছে। সোনালীর মত আরো অনেকেই এভাবে উঠে আসুক- এই প্রত্যাশা আমার।
হাড়িভাসা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের ইউনিয়নের মেয়ে ফেরদৌসি আক্তার সোনালী। হতদরিদ্র পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা এই ফুটবলার আমাদেরও গর্বের। আমরা তার সাফল্য কামনা করি। সোনালী এবং তার দরিদ্র পরিবারের প্রতি প্রশাসন যেন সু-দৃষ্টি রাখে সেই অনুরোধ জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, জাতীয় নারী ফুটবল দলের আরেক গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমেরও বাড়ি পঞ্চগড়ের হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তারা দুইজন পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা। ইয়ারজানও অনুশীলন করেছেন টুকু ফুটবল একাডেমিতে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available