বাংলার ‘টেসলায়’ অচল নারায়ণগঞ্জ শহর
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার নারায়ণগঞ্জ: প্যাডেল চালিত রিকশা প্রায় নেই বললেই চলে নারায়ণগঞ্জ শহরে। এর জায়গা দখল করেছে অটোরিক্সা, মিশুক। এর সঠিক সংখ্যা আর ভাড়ার তালিকা সম্পর্কে ধারণা নেই নারায়ণগঞ্জবাসী এমনকি খোদ কর্তৃপক্ষেরও।গত ৫ আগস্টের পর লাগামহীনভাবে রাস্তায় চলছে এসব অটোরিক্সা, মিশুক। সবকিছু বদলে গেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢুকে পড়েছে শহরের প্রায় প্রত্যেক অলিগলির এলাকাতেও। শুধু তা-ই নয়, বাংলার ‘টেসলা’ খ্যাত এ বাহন রীতিমতো আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।নারায়ণগঞ্জের বিবি রোড, সিরাউজউদৌলা, লিংক রোড, ডিএনডির মূল সড়ক, সরু গলি, কিংবা স্কুল গেট, হাসপাতাল, সর্বত্রই ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। পুরো শহরব্যাপী লাগামহীন মাত্রাতিরিক্ত এস যানে বিরক্ত শহরের বাসিন্দা ও চলাচলকারীরা। তারা জানান, সিগন্যাল ভাঙা, উল্টোপথে চলা, যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছোটা সবই চলছে নির্দ্বিধায়। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে দ্রুতগতির গাড়ি থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী সবাই পড়ছেন ঝুঁকির মুখে। তাছাড়া এতো অটোরিক্সা চালক থাকায় নানাসময় এর চালকরা করছে দুর্ব্যবহার, এমনকি ট্র্যাফিক পুলিশ, ট্রাফিকের দায়িত্বরতদের কাজে বাধা, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে।বাংলার ‘টেসলা’ নামে পরিচিত ব্যাটারিচালিত এ রিকশা এখন নারায়ণগঞ্জে নতুন চিত্র আঁকছে। একবার যাত্রী উঠলেই চালকেরা যেন বনে যান অদৃশ্য রেসার, উচ্চগতির সঙ্গে হঠাৎ ব্রেক, হঠাৎ মোড় নেওয়া; যা যাত্রীদের জন্য এক আতঙ্কের যাত্রায় রূপ নেয়। সবমিলিয়ে এই বাহন নিয়ে বিরক্ত বাসিন্দা-চলাচলকারী সবাই।অথচ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান নিয়মানুযায়ী শুধু নির্দিষ্ট সংখ্যক ও নিবন্ধিত হলুদ রঙের প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করার কথা। মনিটরিং আর সঠিক হিসাবের হেরফেরে এসব বাহনের কারণে গোটা শহর এলাকার সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে যেন কেউ নেই!জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন থেকে মাত্র ১৭ হাজার ৩৪২টি মিশুককে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মিশুক চলছে কমপক্ষে ৪৫ হাজারেরও বেশি। তারা সবাই বলছে তাদের মিশুক রেজিস্ট্রেশন করা। তাহলে তারা এত মিশুকের রেজিস্ট্রেশন পেল কোথা থেকে?অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি মিশুকের রেজিস্ট্রেশন দিয়ে প্রায় ১০টিরও বেশি মিশুক চলছে এ শহরে। কিছু অসাধু মিশুক মালিকরা সিটি কর্পোরেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি মিশুকের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নকল করে আরও দশটি মিশুকের পিছনে সাঁটিয়ে পুরো দমে ব্যবসা করে যাচ্ছে। শুধু মাত্র নাম্বার ভিন্ন ছাড়া রেজিস্ট্রেশন কার্ডগুলো দেখতে প্রায় একই রকম হওয়ায় বুঝার উপায় নেই যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। আর এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ওই চক্রটি লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই চক্রটির কারণে হাজার হাজার মিশুকের চাপে শহরে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট, আর এ যানজটের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নগরবাসী। শুধু তাই নয়, ওই মালিক চক্রটির কারণে প্রকৃত মিশুক মালিকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা এ বিষয়ে একাধিকবার সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেও ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন গণমাধ্যকর্মীদের।বর্তমানে বিশৃঙ্খল ভজকট অবস্থা পুরো শহরে। মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি এমন কোথাও নেই যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে না। ট্রাফিক পুলিশ, সোসাইটি, সিটি কর্পোরেশন, এলাকাবাসী, স্থানীয় বাসিন্দা, যাত্রী কেউই এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারা এসে সরাসরি ঢুকে যাচ্ছে এসব এলাকায়। অদক্ষ এসব চালকের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা। ভাড়া নিয়েও তারা চালাচ্ছে নৈরাজ্য। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ব্যাটারিচালিত রিকশা আসায় ভাড়ার তালিকা আর কেউ মানে না। তাদের রিকশার কারণে ভয় হয় চলাচল করতে। বাধ্য হয়ে চলতে হয়। এসব রিকশায় উঠলে মনে হয় তারা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে নিজের মধ্যে ভয় আরও বেড়ে গেছে। রাস্তা পার হওয়ার সময় আগে দেখি এসব রিকশা আসছে কি না।নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি রহমান বিশ^াস বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের যানজট নিরসনের জন্য সিটি কর্পোরেশন আগে যে রিকশার লাইসেন্সগুলো ছিল, সেগুলোকে কনর্ভাট করে মিশুকের নামে দিয়েছে। কিন্তু পরবির্ততে কিছু দুষ্ট লোক সেই লাইসেন্সগুলোকে রাতারাতি কপি করে ফেলে। এ কপি করার ফলে শহরে মিশুকের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে যানজট নিরসনে সিটি কর্পোরেশন যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলো সেটা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, একই নাম্বারের গাড়ী যদি ৫টা ছয়টা চলে তাহলে কীভাবে যানজট নিরসন হবে। একই নাম্বারের গাড়ী একটিই থাকতে হবে। তাহলে গাড়ীর সংখ্যাও কম থাকবে আবার যানজটও কমে যাবে।তিনি বলেন, আমরা হাতে নাতে একটি প্রিন্টিং প্রেসে মিশুকের প্লেট জাল করতে দেখে সিটি কর্পোরেশন এবং থানার ওসিকে কল করেছিলাম। আমরা অনেকক্ষন অপেক্ষা করেছিলাম ভাবছিলাম, হয়তো আইনগত কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু আমরা প্রায় তিনঘন্টা অপেক্ষা করার পর যখন দেখলাম তাদের কোন সাড়াশব্দ নাই, তখন এক কথায় নিরাশ হয়ে ফিরে যাই।