কালাই(জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: জয়পুরহাটের পোলট্রি খাত একসময় দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানকার খামারগুলোতে উৎপাদিত হতো দেশীয় স্বাদের কাছাকাছি সোনালি জাতের ব্রয়লার মুরগি, যার চাহিদা ছিল সারা দেশে। তবে সম্প্রতি জেলার এই খাতটি ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে।
এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় দুই থেকে আড়াই গুণ কমে যাওয়ায় হ্যাচারি মালিকেরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে হ্যাচারি বন্ধ করে দিচ্ছেন বা প্যারেন্ট স্টক বিক্রি করে দিচ্ছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জয়পুরহাটে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি খামার ও ৫৩টি সচল হ্যাচারি রয়েছে। এসব হ্যাচারিতে বছরে প্রায় ৮ কোটি এক দিনের বাচ্চা উৎপাদিত হয়, যার একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। এখানেই উদ্ভাবিত হয়েছে সোনালি জাতের ব্রয়লার, যার স্বাদ অনেকটা দেশি মুরগির মতো।
তবে এখন এই খাতে দেখা দিয়েছে একাধিক সমস্যা। কয়েক বছর ধরে বাজারে অস্থিরতা, খামারিদের ক্রমাগত লোকসান, ওষুধ ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং জলবায়ুগত প্রতিকূলতার কারণে ছোট ও মাঝারি খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে অতিরিক্ত গরমে মুরগির বাচ্চা বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় অনেক খামারি নতুন বাচ্চা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এতে হ্যাচারিগুলোর উৎপাদিত বাচ্চা বিক্রি না হওয়ায় সেগুলো অতি সস্তায় অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
জয়পুরহাটের হ্যাচারিগুলোতে সাদা ব্রয়লার জাতের এক দিনের বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ৪৫ টাকা, রঙিন ব্রয়লারে ৩৮ টাকা এবং সোনালি জাতের বাচ্চায় খরচ পড়ছে ১৮ টাকা করে। অথচ, বাজারে এই বাচ্চাগুলো বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ১২, ১০ ও ৫ টাকায়। হ্যাচারি মালিকদের অভিযোগ, কখনো কখনো বাচ্চা বিক্রি না হওয়ায় তা মাটিচাপা দিতেও হয়েছে।
কালাই উপজেলার মের্সাস শাকিলা পোলট্রি ফার্ম ও হ্যাচারির ব্যবস্থাপক মোফাজ্জল হোসেন মাহিন জানান, আমরা মূলত সোনালি জাতের বাচ্চা উৎপাদন করি। প্রতিটি বাচ্চায় ১৮ টাকা খরচ হলেও এখন তা চার-পাঁচ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতিটি বাচ্চায় ১৩ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। এমনকি কখনো কখনো বিনামূল্যে দিচ্ছি, তাও কেউ নিতে চায় না।
এ অবস্থা চলতে থাকলে এই জেলার পোলট্রি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। পদ্মা ফিড অ্যান্ড চিকেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল হক বলেন, গত এক মাস ধরে জাতভেদে প্রতিটি বাচ্চায় ১৩ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। মিডিয়াগুলো যখন মুরগির দাম বাড়ে তখন ব্যাপক প্রচার করে। কিন্তু যখন হাজার হাজার হ্যাচারির লোকসানে দিশেহারা অবস্থা তখন তারা নিশ্চুপ।
কালাই উপজেলার প্রান্তিক খামারি আবুল কাসেম, আবু জাকারিয়া ও মোজাহার হোসেন বলেন, একসময় সোনালি মুরগি দিয়ে লাভবান হয়েছিলাম। কিন্তু এখন খরচের ভার আর বহন করতে পারছি না। বাধ্য হয়ে খামার বন্ধ করেছি।
কালাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, হ্যাচারি মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন, এটা সত্য। আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও তথ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।
জেলার পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, অপরিকল্পিত উৎপাদন, গরমে মৃত্যুহার বৃদ্ধি, খাদ্য ও ওষুধের উচ্চ মূল্য এবং বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা খাতটিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ না করলে খামারিরা ন্যায্য দাম পাবে না।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন জানান, এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আশা করা হচ্ছে। বাজারে পুনরায় চাহিদা তৈরি হলে দামও বাড়বে। তবে শিল্পটি যাতে একেবারে ধ্বংস না হয়ে যায়, সেজন্য পরিকল্পিত উৎপাদন ও সরকারি সহযোগিতা জরুরি।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available