১৪ বছরেও বুটেক্সে অধরা মানসম্মত স্থায়ী ক্যান্টিন: বারবার স্থানান্তরে ভুগছে শিক্ষার্থীরা
বুটেক্স প্রতিনিধি: প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ক্যাম্পাসে একটি মানসম্মত স্থায়ী ক্যান্টিনের অভাব শিক্ষার্থীদের জন্য এক দীর্ঘশ্বাস। বারবার ক্যান্টিনের স্থান পরিবর্তন, নিম্নমানের খাবার এবং উচ্চমূল্য এসবই বুটেক্স শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের অভিযোগ। কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব এবং পরিকল্পনাহীনতাই এই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।ক্যান্টিনের অনিশ্চিত ইতিহাস: এক দশকে বারবার রদবদলবুটেক্সের ক্যান্টিন ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটি যেন এক যাযাবর জীবন পার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্যান্টিন অন্তত তিনবার স্থানান্তরিত হয়েছে।প্রাথমিকভাবে, বুটেক্সের দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মাসউদ আহমেদ-এর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় একটি ছোট পরিসরে ক্যান্টিন পরিচালিত হতো যার পরিবেশ ছিলো র্শিক্ষার্থীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। তৎকালীন সময়ে ক্যানটিনে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি নেতাকর্মীদের বিল পরিশোধ না করার কারণে ক্যানটিন মালিক ধারাবাহিকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ক্যানটিনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সাবেক উপাচার্য আবুল কাশেমের উদ্যোগে ক্যানটিনটি পুনরায় চালু হয়।এরপর চতুর্থ উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামান-এর আমলে নতুন একাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ক্যান্টিন স্থানান্তর করা হয়। এটি ছিল তুলনামূলকভাবে একটি বড় এবং আধুনিক পরিসর, যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বসার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল এবং খাবারের মানও কিছুটা উন্নত হয়েছিল। তবে সেই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বর্তমানে সেই ক্যান্টিনকে স্থানান্তর করে টিনশেড কাঠামোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ঘন ঘন স্থানান্তরের ফলে প্রাপ্য ক্যান্টিন সুবিধা হতে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন।কেন এই বারবার স্থানান্তর? অদূরদর্শী পরিকল্পনার খেসারতক্যান্টিন বারবার স্থানান্তরের পেছনে কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবই প্রধান কারণ। নতুন একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরিত হওয়ার পর ক্যান্টিন ভালোই চলছিল। কিন্তু সেখান থেকে ক্যান্টিন সরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে "গ্যাসের লাইনের অভাব" অজুহাত দেখানো হয়েছিলো। প্রশ্ন ওঠে, একটি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের সময় কেন গ্যাসের লাইনের মতো অত্যাবশ্যকীয় সুবিধার কথা মাথায় রাখা হয়নি? এটি সুস্পষ্টভাবে নির্মাণ পরিকল্পনার দুর্বলতা এবং দূরদর্শিতার অভাবকেই নির্দেশ করে। ফলস্বরূপ, একটি আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ক্যান্টিন পরিচালনার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করে অস্বাস্থ্যকর টিনশেডে নিয়ে আসা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমানে দায়িত্বরত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ মো. মামুন কবীর বলেন, ক্যান্টিনটি পূর্ববর্তী উপাচার্যের আমলে একাডেমিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো তখনও ভবনটিতে গ্যাস লাইনের ব্যবস্থা ছিলোনা। তবে একাডেমিক ভবনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন করে গ্যাস লাইন সরবরাহ না করে ক্যান্টিনটি বর্তমানে প্রশাসনিক ভবনের পাশে স্থানান্তরিত করা হয়েছেএবং আসন সংকট নিরসনে বর্তমানে ক্যান্টিনের পরিধি বাড়ানোর কাজ চলছে। আশা করছি খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে।উচ্চমূল্য ও নিম্নমানের খাবারশিক্ষার্থীদের আরেকটি বড় অভিযোগ হলো ক্যান্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রে একসময় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চাঁদা চাওয়ার উৎপাত ছিলো যা বর্তমানে নেই, এরপরেও ক্যান্টিনের খাবারের এমন উচ্চমূল্য এবং নিম্নমান কেনো?ক্যান্টিন মালিকরা প্রায়শই দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন, যার পেছনে বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান। বুটেক্সের ক্যান্টিন শুধুমাত্র দিনের বেলায় চলে, রাতে শিক্ষার্থীদের জন্য ডাইনিং সুবিধা চালু থাকায় ক্যান্টিনে বেচাকেনা কম হয়। দিনের বেলায় সীমিত বেচাকেনার মাধ্যমে কর্মীদের বেতন, মোটা অঙ্কের ভাড়া এবং অন্যান্য পরিচালন ব্যয় মেটানো ক্যান্টিন মালিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণও খাবারের মূল্যে প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু, ক্যান্টিন পরিচালককে উচ্চমূল্যের মাসিক ভাড়া পরিশোধ করতে হয় বলে জানা গিয়েছে। এই উচ্চ ব্যয় মেটাতে গিয়ে ক্যান্টিন মালিকরা খাবারের মান ধরে রাখতে পারেন না এবং দাম বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন।টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. রাকিব সরদার অভিযোগ জানিয়ে বলেন, ক্যান্টিনে খাবারের মান ও দাম নিয়ে অভিযোগ কমার কথা ছিল, উল্টো এখন আরও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, আগে ছাত্রলীগ চাঁদা নিত বলে সমস্যা হতো, এখন তো সেটা নেই তবুও অবস্থা আগের মতোই। কিছু খাবারের দাম বাইরের তুলনায় বেশি, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভর্তুকি দেওয়ার কথা। আমি মনে করি, ক্যান্টিন ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।শিক্ষার্থীদের অভিযোগের কথা কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে অধ্যাপক ড. মামুন কবীর বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসে, তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা করেছি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মূল্য তালিকা নির্ধারণ করে দেওয়ার পাশাপাশি খাবারের গুণগত মান নিশ্চিত ও খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।স্টুডেন্ট-ড্রাইভেন ক্যান্টিনের প্রয়োজনীয়তা: হল বনাম ক্যাম্পাস ক্যান্টিনবিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পরিচালিত ক্যান্টিনগুলোতে খাবারের মান যথেষ্ট ভালো থাকে এবং দামও তুলনামূলকভাবে কম হয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, হলের ক্যান্টিনগুলো শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে এবং তাদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিচালিত হয়। এখানে মুনাফার চেয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার পরিবেশনের দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ক্যাম্পাসের মূল ক্যান্টিনটি ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় মুনাফার দিকেই তাদের বেশি নজর থাকে। এর ফলে খাবারের মান নিয়ে আপোষ করা হয় এবং দামও বেশি রাখা হয়, যা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।বুটেক্সে শিক্ষার্থীদের দ্বারা ক্যান্টিন পরিচালনার সম্ভাব্যতা নিয়ে জানতে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মামুন কবীর ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা চাইলে ক্যান্টিনের দায়িত্ব নিয়ে উদ্যোক্তা হতে পারবে। তবে এর জন্য কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে।ড. মামুন কবীরের মতে, একজন শিক্ষার্থীকে ক্যান্টিন পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স এবং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়াও খাদ্য ব্যবসার লাইসেন্স, টিআইএন, ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তিপত্র থাকতে হবে।